সাম্প্রতিক পোস্ট

ঢাকার গাছের ছায়াই যাদের কাছে সরকারী সেবা!

ঢাকার গাছের ছায়াই যাদের কাছে সরকারী সেবা!

ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীর আলম

সালমা বেগম, বয়স ৩৫, স্বামী মো. বেলায়েত আলী, বর্তমান ঠিকানা বাংলামোটর এবং সোনারগাঁও হোটেলের মাঝখানে পান্থকুঞ্জ পার্কের গা ঘেঁষে ফুটপাতে। স্থায়ী ঠিকানা গ্রাম-বালিজ্জ্য, পো. বেলাবাড়ি, উপজেলা-আদিতমারী, জেলা-লালমনিরহাট। এক ছেলে এক মেয়ে গ্রামের বাড়িতে দাদীর কাছে থাকে। সালমা বেগম বাসা বাড়িতে কাজ করে ৪৫০০ টাকা আয় করে আর স্বামী বেলায়েত সিটি কর্পোরেশনের ময়লা পরিস্কারের কাজ করেন। বেতন পায় ৯৫০০ টাকা। মোট পরিবারের দুই জনের আয় ১৪০০০ টাকা। ১৫ বছর আগে ঢাকা এসে এই ফুটপাতেই থাকা শুরু করেন কম আয় করার কারণে। ফুটপাতে থাকেন বলে তাদের বাসা ভাড়া দিতে হয় না বটে কিন্তু ফুটপাতে থাকার কারণেই প্রতি মাসে তাঁদের গুণতে হয় একটি মোটা অঙ্কের টাকা!

20171203_123247

ফুটপাতে থাকার কারণে তাদের জন্য নেই কোন বাথরুমের ব্যবস্থা। ফলে সরকারিভাবে তৈরি পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করার কারণে তাদের প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০ টাকা খরচ হয়। প্রতিদিনের বাথরুম ব্যবহারের খরচ হিসাব তিনি বলেন, “প্রতিবার বাথরুম ব্যবহার করার জন্য দিতে হয় ৫ টাকা করে, গোসল করা বাবদ দিতে হয় ১০ টাকা আর রান্না ও থাওয়া বাবদ পানি আনতে গেলে প্রতি গ্যালন পানির জন্য দিতে হয় ৫ টাকা।” তিনি আরও বলেন, দুই জনের গড়ে প্রতিদিন ৭০-৮০ টাকা বার্থরুম ব্যবহার খরচ। গড়ে মাসে ২০০০-২২০০ টাকা খরচ হয় বাথরুম ব্যবহার ও পানি সংগ্রহ বাবদ।

ভাসমান এই বস্তিতে থাকেন প্রায় ১০০টি পরিবার। বাথরুম ব্যবহার করার জন্য প্রতিটি পরিবার প্রায় সমান পরিমাণ টাকা খরচ হয়। একটা হিসেব করে দেখা গেছে শুধু পাবলিক টয়লেট ব্যহার বাবদ ১০০টি পরিবার মাসে প্রতিমাসে গড়ে ২,০০,০০০- ২,২০,০০০ (দুই লাখ থেকে দুইলক্ষ বিশ হাজার) টাকা খরচ করে থাকেন।

সালমা বেগম জানান, তাদের গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে মালদহ নদীর কারণে প্রতিবছর বন্যা হয়। ফলে বালি পড়ে মাঠের কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে জমিতে আর আগের মতো ধানের চাষ হয় না। এখন শুধু ভুট্টা, সবজি এবং বাদামের চাষ হওয়ার কারণে তাদের কাজ করার তেমন কোন সুযোগ থাকে না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে এসে এই ভাসমান বস্তিতে উঠেছেন। এখানে তারা সন্ধ্যার পর পার্কের পশ্চিম পাশে সীমানা বেড়ার গায়ে পলিথিন দিয়ে ঘর তৈরি করে এবং সকাল হওয়ার আগেই তারা সেই ঘর খুলে বেড়ার সাথে পেঁচিয়ে রাখেন। দিনের বেলায় সেখানে গেলে বোঝাই যাবে না যে এখানে ১০০ পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষের বসবাস করেন। অধিকাংশই পুরুষই রিকশা, ভ্যান চালায়, লেবার দেয়, এবং সিটি কর্পোরেশনের ময়লা পরিস্কারের কাজ করেন। নারীরা বাসা বাড়ির কাজ, চা পানের দোকান এবং টুকাইয়ের কাজ করেন। বৃদ্ধ মানুষেরা অন্যের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা (ভিক্ষা করে) নিয়ে বেঁচে থাকেন। তিনি বলেন, “মাঝে মধ্যে পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের লোক এসে ফুটপাত পরিস্কারের নামে তাদের ঘর ভেঙে ট্রাকে করে নিয়ে যায়।”

20171219_160029

বছরে গড়ে দুইবার এই রকম সমস্যায় তারা পড়েন। তাদের ভাসমান ঘরে নেই কোন বিদ্যুৎ বা আলোর ব্যবস্থা, রান্নার গ্যাস, এবং নেই পানির পাওয়ার অধিকার, তারপরও তারা নগরবাসী। এই বস্তিবাসীরা জানান, বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টি হলে রাস্তা ডুবে ফুটপাতে পানি এসে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে, ফলে কাপড় চোপড় বিছনাপাতি সব ভিজে যায়। ফলে তারা না পারে ঘুমাতে, না পারে কাজ করতে। এই সাথে তাদের রয়েছে চলাফেরার সমস্যা, কাজের সমস্যা। গরমের সময় প্লাস্টিক ঘরের মধ্যে প্রচন্ড গরম তৈরি হয়। ফলে ঘরের মধ্যে থাকা অনেক কষ্ট হয়। গরমের সময় ঘেমে যাওয়ার কারণে তারা ঘরের বাইরে এসে সময় পার করে। পাশাপাশি আছে মশার, পিঁপড়ার কামড়ের যন্ত্রণা।

সালমা বেগম বলেন, “শীতের সময় আমাদের অনেক কষ্ট হয়। ফুটপাতে শীত আরো বেশি।” জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব তাদের জীবনকেই দূর্বিসহ করে তুলেছে। তারপরও তারা প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমরা কষ্ট করে যাচ্ছি শুধুমাত্র দুটি সন্তানের ভালো ভবিষ্যত তৈরি করার জন্য, যাতে তাদেরকে আমাদের মতো কষ্ট করতে না হয়।

সরকারি সেবার বিষয়ে জানান, শুধু গাছের ছায়া ছাড়া অন্য কোন সেবা তারা পান না। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের যে অধিকার থাকার কথা তার কিছুই তারা পাচ্ছেন না। যেন নিজভুমে পরবাসী।
সবার জন্য শহর এই ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করতে একটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছানো দরকার এবং তা হলো-দরিদ্র জনগোষ্ঠির শহরে বাস করার সমান অধিকার রয়েছে। তাদের মাধা গোঁজার ঠাঁই খোঁজার ইচ্ছাকে অপরাধ হিসেবে না ভেবে তাদেরকে শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হবে। ডগ শান্ডার এর নব্য প্রকাশিত বই ‘এরাই ভাল সিটিতে’ তিনি বলেছেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠি শহরকে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলতে পারে যদি অনিশ্চয়তায় না রেখে তাদেরকে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার দেওয়া হয়।

happy wheels 2

Comments