হে ঈশ্বরের সন্তান, ক্ষমা করো আমাদের...

হে ঈশ্বরের সন্তান, ক্ষমা করো আমাদের…

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

রাত দুপুরে আমাদের মেকি সভ্যতা যখন নিথর হয়ে তুলতুলে বালিশের উপর মাথা রেখে শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন, তখনো এক শ্রেণির মানুষ নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখে। শহরের প্রধান রাস্তা, অলিগলি থেকে শুরু করে বাজার, নর্দমা, বাস স্ট্যা- এমনকি পাবলিক টয়লেট যাদের হাতের ছুঁয়া একদিন না পড়লে আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বসবাসের অনুপযোগি হয়ে যায় আমাদের আধুনিক নগর সভ্যতা। আমরা নতুন বরের মতো নাকে রুমাল চেপে পথ চলি।

IMG_20180129_123212
যারা আমাদের নৈমিত্তিক সুন্দর পথ চলাকে উপহার দেয়, তাঁদের ক’জনের খবর আমরা রাখি ? তাঁদের কি আমরা চিনি ? আমরা কি জানি তাঁদের পরিচয় ? নিশ্চই কোনো রূপকথার দৈত্য বা পরী এসে আমাদের শহরকে সাজিয়ে দিয়ে যায়না ? যারা এই কাজটি করে তাঁরাও আমাদের মতো রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। সুখ-দুঃখ তাঁদেরও আছে। আমরা নোংরা পরিবেশ পছন্দ করিনা, অথচ যারা নোংরা পরিষ্কারের কাজ করে তাদেরকে ঘৃণা করি। তাঁরা ছুলে আমাদের জাত যায় ! আমাদের ভাষায় তাঁরা অচ্ছ্যুত, অস্পৃশ্য, দলিত।

দলিত কারা
জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার মানুষরা আন্তর্জাতিক পরিসরে দলিত নামে পরিচিত। আমাদের সমাজে দুই ধরণের দলিত আছে যেমন, বাঙালি দলিত ও অবাঙালি দলিত। অবাঙালি দলিত শ্রেণির মধ্যে কানপুরী বা হরিজন উল্লেখযোগ্য।

হরিজন কাদের বলা হয়
ভারতের কানপুর, এলাহাবাদ ও নাগপুর থেকে আসা জনগোষ্ঠীই মূলত হরিজন নামে পরিচিত। এঁরা পূর্ব পুরুষের আমল থেকে বাংলাদেশে বসবাস করছেন, যারা হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য করে রাখা সম্প্রদায়। রেলওয়ে কলোনী, স্টেশন অথবা গণপূর্ত বিভাগের জায়গায় এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। বিভিন্ন হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেল স্টেশন ও পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে এরা কাজ করে। আমাদের দেশে এদের সুইপার বা মেথর বলেই ডাকা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও সাধারণ হিন্দুদের সাথে এদের অনেক পার্থক্য আছে। বাংলা ভাষায় কথা বললেও এঁদের মাতৃভাষা ভোজপুরী।

ভোজপুরী ভাষায় কথা বলা মানুষের বসবাস বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো নেত্রকোনা শহরেও আছে। নেত্রকোনা সদরের আরামবাগ এলাকায় (পুরনো জেলখানার পাশে) গণপূর্ত বিভাগের জায়গায় হরিজন সম্প্রদায়ের ৭টি পরিবার বসবাস করে। দলিত শ্রেণির মধ্যে এঁরা বাঁশফোর সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে সকলেই নিরক্ষর। শিক্ষার আলো নেই বললেও চলে। প্রবীণ থেকে শুরু করে পরিবারের ছোট শিশুটিও কোনো দিন বই খাতা হাতে বিদ্যালয়ের দরজায় যেতে পারেনি।

শিক্ষা
বিদ্যালয়ের দরজায় যেতে পারেনি বললে ভুল হবে, আসলে তাঁদের যাওয়ার মতো কোনো উপায় নেই। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে ভাষাগত সমস্যা। একটি শিশু জন্মের পরে যে ভাষায় কথা বলতে শিখে সে ভাষাতেই শিক্ষা জীবন শুরু করে। মায়ের মুখের ভাষা শুনে সে বড় হয়। এবং আস্তে আস্তে সে শিখে নেয় সেই শব্দগুলো কিভাবে লিখতে হয়। বাঁশফোর সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে, পরিবারের সবাই এ ভাষাতেই কথা বলে। শিশুরাও সেটা শুনে এবং শিখে নেয়। তাছাড়া বংশ পরস্পরায় বাংলাদেশে বসবাস করে বাংলা ভাষায় কথা বলাটা শিখে নিলেও আয়ত্ব করতে পারেনি এর লিখিত রূপ। তাঁরা যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই শহরে নেই। সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংগঠন কখনো এখানে কাজ করতে আসেনি। বা তারা নিজেরাও এ বিষয়ে সচেতন নয়। যে কারণে পরিবারের সদস্যদের শিক্ষার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তাঁরা শুধুমাত্র নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে।

পেশা
ব্যস্ত থাকে আরো একটি কাজে, সেটি হলো শূকর পালন। এই পল্লীর অনেকেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাজের সাথে যুক্ত নয়। তাই সংসার চালানোর জন্য শূকর পালন ও বিক্রি করেই এঁদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। একটি পরিবারের একজন নারী শুধুমাত্র পার্শ্ববর্তী উপজেলায় সরকারী হাসপাতালের সুইপার হিসেবে কাজ করেন। এই কলোনির বেশিরভাগ যুবকরাই বেকার। তারা সারাদিন বাড়িতেই থাকে, প্রয়োজনে সংসারের কাজ যেমন রান্না করা, সন্তানের দেখভাল ইত্যাদি কাজে সাহায্য করে। শহরের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য মাঝে মাঝে এদেরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কারো বাড়ির টয়লেট নোংরা হয়ে গেছে বা কারো দোকানের পাশে কোনো প্রাণি মরেছে, সমস্যা নেই সুইপার বা মেথর তো আছেই।

আবাসন সমস্যা
মেথর/বাঁশফোর সম্প্রদায়ের এই ৭টি পরিবারের প্রায় ৩০ জন মানুষ যেটুকু জায়গায় বসবাস করে সেখানে ধনী শ্রেণির রান্না ঘরের জায়গাও এর থেকে বেশি থাকে। মাঝে মধ্যে সরকারি অফিস থেকে এদেরকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাগাদা দিয়ে যায়, কিন্তু এরা ছাড়েনা। জায়গা ছেড়ে কোথায় যাবে। দু’বেলা দু মুঠো খেতে পায়না যারা, তাদের ঘর ভাড়া করার সামর্থ্য কোথায় ? অনেক কষ্ট করে একটি মাত্র ঘরে পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে থাকে। যেখানে বসে রান্না করছে সেখানেই পরিবারের ছোট সদস্যটি পায়খানা করছে। ঘরে বসে তরকারী বা মাছ কাটার জায়গাও নেই। তাই বেশিরভাগ সময়ে এরা রাস্তায় বসে এ কাজগুলো সারে। তাছাড়া কোনো আত্মীয় পরিজন বা অতিথি এলেও তাঁদের বসতে দেওয়ার মতো জায়গা হয় পথের ধারেই।
IMG_20180129_124258
পথের ধারে বসেই সংসারের সুখ দুঃখের গল্প করে তাঁরা। এঁরা নোংরা পরিষ্কারের কাজ করলেও সরকার এঁদের থাকার ব্যবস্থা করে নোংরা আবর্জনার পাশেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই যদিও হয় নেই কোনো পানীয় জলের ব্যবস্থা। খাবারের জল সংগ্রহ করে রাস্তার কোনো কল থেকে বা সদর হাসপাতালের পানির লাইন থেকে। তাও আবার প্রতিদিন পাওয়া যায় না। পানি আনতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাঁদেরকে গালিও শুনতে হয়। কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, টয়লেট ব্যবহার ও গোসলের কাজ করে এঁরা নদীর পানি ব্যবহার করে। প্রত্যেক পরিবারের নারী সদস্যরা প্রতিদিন খলই বোঝাই থালা বাসন ও কাপড় মাথায় নিয়ে নদীতে চলে যায়। সাথে করে নিয়ে যায় পরিবারের অন্য সদস্যদেরকেও। গোসল সেরে ফিরে আসার সময় কলস ভরে পানি নিয়ে আসে, যে পানিটুকু দিয়ে তারা অন্যান্য ধোয়া মুছার কাজ করে।

ধর্মীয় আচার
কাজ করার পাশাপাশি বাঁশফোরগণ সমস্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। হিন্দু ধর্ম অনুসারে তাঁরা সকল পূজা পার্বণ পালন করেন। তাঁদের নিজস¦ কোনো মন্দির নেই। সকলের সাথে মিলে মিশে তাঁরা উৎসব উদ্যাপন করেন। তবে তাঁরা একটি বিশেষ ধরণের পূজা করেন যা অন্যরা করেননা। সেটা হলো ‘তিন নাথ’ ঠাকুরের পূজা। এই পূজা তারা পরিবারের প্রত্যেক সদস্য’র বিয়ের সময় করে থাকেন। এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হয়না। ধর্মীয় রীতিতে এঁরা খুব অনুগত।

সমাজ ব্যবস্থা
অনুগত থাকে পরিবারের পুরুষ সদস্যটির প্রতিও। কারণ বাঁশফোরদের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের পুরুষদের কথাই শেষ কথা। নিজেদের সমাজ পরিচালনার জন্য এই সম্প্রদায়ের মধ্যেই একজন সমাজপতি আছেন। তাঁর নির্দেশেই চলে সামাজিক কার্যক্রম। তিনিও একজন পুরুষ। এঁদের পরিবারে নারী সদস্যরা পুরুষদের পাশাপাশি বাইরে গিয়ে পরিচ্ছন্নতা বা সাংসারিক প্রয়োজনীয় কাজ করলেও পরিবারে তাঁদের মতামতের কোনো মূল্য দেওয়া হয়না।

IMG_20180207_113355

ভাষা এবং শাড়ি পড়ার ধরনই এঁদেরকে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদের থেকে আলাদা করে। তাছাড়া হিন্দু সমাজের মধ্যে নিচু শ্রেণির মানুষ হওয়ার কারণে এঁদের সাথে কেউ মেলামেশা করতে চায়না। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক করে নিজস্ব সমাজের ভেতরেই। বাঁশফোর সমাজে বাল্য বিয়ের প্রচলন আছে। এখানে বসবাসরত পরিবারে বৌদের বয়স ১৫ বছরের উর্ধ্বে নয়। তাও আবার প্রত্যেকেই একজন বা দু’জন সন্তানের জননী। এঁদের মধ্যে একজন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছে বাকিদের কেউ শিক্ষিত নয়।

স্বাস্থ্য
শিক্ষিত নয় বলেই এঁরা নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও সচেতন নয়। বাড়ির পাশে রাস্তার উপর আছে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। ঘরের পাশেই আছে নর্দমা, সেখানে মাছি উড়ছে। সেই মাছি আবার গিয়ে খাবারের থালায় বসছে। বর্ষাকালের অবস্থা আরো করুণ। নর্দমার পানি উপচে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। এই পানিতেই খেলায় মেতে উঠে ছোট শিশুরা। ৭টি পরিবারের জন্য একটি মাত্র টয়লেট আছে। সেখানেও তাঁরা খালি পায়ে যাতায়াত করে। রান্না করার জন্য এঁদের কোনো আলাদা ঘর নেই। থাকার ঘরের পাশে লাগোয়া একটি চাল তৈরি করে সেখানেই রান্নার কাজ সারেন। কেউ আবার রান্না করেন খোলা আকাশের নিচেই। চুলা থেকে বের হওয়া ধোঁয়ায় সমস্ত পরিবেশ অন্ধকার হয়ে যায়।

পরিশেষে
অন্ধকার হয়ে আছে যেমন তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। প্রয়োজনের তাগিদে আমরা প্রতিদিন ছুটে বেড়াই নানা প্রান্তরে। সব কিছুকে পেছনে ফেলে শুধু সামনে যেতে চাই। কিন্তু সামনে চলতে গিয়ে বারবার যে পিছিয়ে পড়ি সেটা কি ভেবে দেখছি ? আমরা মানুষ, না শুধু মানুষ নয় সভ্য মানুষ। তাই নিজেকে সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছাতে গিয়ে আমাদের মতো এই সমাজে আরো যে মানুষ আছে তাঁদেরকে মনে রাখিনা। হরিজন পল্লী বাংলাদেশের বাইরের কোনো এলাকা নয়। এই পল্লীর বাসিন্দাদের আছে জাতীয় পরিচয় পত্র, তাই তারাও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভোট দানে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদের মানুষ হয়েও এরা মানুষের মর্যাদা পায়না। জীবনের সকল স্তরেই উপেক্ষিত হয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। মহাত্মা গান্ধীর দেয়া নাম ‘হরিজন’ অর্থাৎ ঈশ্বরের সন্তান। অথচ এঁদের অবস্থা বা অবস্থান দেখে বোঝার উপায় নেই ঈশ্বরের দৃষ্টি আদৌ এঁদের উপর পড়েছে কিনা। তাই আজ বারবার বলতে ইচ্ছে করে, “হে ঈশ্বরের সন্তান ক্ষমা করো আমাদের”।

তথ্যসূত্র: নেত্রকোনা হরিজন পল্লীর বাসিন্দা ও বাংলা পিডিয়া।

happy wheels 2

Comments