মাছ শিকারি মাছরাঙা আজ বিলুপ্তির পথে!

মাছ শিকারি মাছরাঙা আজ বিলুপ্তির পথে!

আসাদ রহমান, সাতক্ষীরা থেকে 

দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে মাছ শিকারি মাছরাঙা। মাছরাঙার আর মাছ শিকার এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। এখন মাছরাঙার সংখ্যা অনেকে কমে গেছে জানিয়েছেন প্রাণীবিদরা।

সূত্রে জানা গেছে, বাংলা নাম ‘মাছরাঙা’, ইংরেজি নাম: Kingfisher, বৈজ্ঞানিক নাম: Alcedo atthis, আলসেডিনিডি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত আলসেডো গণের অন্তর্গত রঙচঙে খুদে মৎস্যশিকারি পাখি। মাছ রাঙার আবার বিশেষ গুণ রয়েছে। তাদের থাকার জন্য এলাকা ভাগ রয়েছে। এই জায়গাটিতে অন্য কোন মাছরাঙার প্রবেশাধিকার নেই। কাছে এলেই তাড়িয়ে দেবে। পুকুরের পাশে, বিলের পাশে বা ঝিলের পাশের পাড়ের মাঠিতে গর্ত করে বাসা তৈরি করে সেখানে তারা থাকে।

download

মুক্তবিশ্বকোশ বাংলা পিডিয়া সূত্রে জানা গেছে, ‘মাছরাঙা’ GivCoraciiformes বর্গের Alcedinidae, Halcyonidae ও Cerylidae গোত্রভুক্ত খাটো পুচ্ছ, বড় মাথা, সুচালো ঠোটের আটোসাটো গড়নের একটি পাখি। শিকার ধরার জন্য পানির দিকে মাথা নিচু করে ছোঁ মারে, প্রায়শ পানির ভিতরে ঢুকে যায়, শিকারকে গাছের ডালে নিয়ে ফিরে আসে এরপর কয়েকবার আছাড় মারে তারপর শূন্যে ছুড়ে দিয়ে মাথার দিক থেকে গিলে ফেলে। পৃথিবীব্যাপী ৯৪ প্রজাতির মাছরাঙা রয়েছে, বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির মাছরাঙা আছে। তবে আমাদের দেশে সচারচর যে মাছরাঙা বেশি দেখা যায় তার নাম BlythÕs Kingfisher (Alcedo hercules); এরা শৃশ্যত আকারে বেশ বড় মিশ্র হরিৎ বনাঞ্চলে দেখা যায়। মাছরাঙার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। নিচে সেসব প্রজাতি নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১। ছোট নীল মাছরাঙা
এরা নীল মাছরাঙা লম্বায় প্রায় ১৮ সে.মি.। স্ত্রী-পুরুষ দুজনে দেখতে একই রকম। গায়ের উপরের পালক উজ্জ্বল নীল, শরীরের কিনারে ও ডানায় সবুজের ছোঁয়া আছে। মাথায় কালচে নীল রঙের টানাটানা দাগ। পায়ের রঙ লাল। এরা সোজাসুজি এবং বেশ দ্রুত ওড়ে। নিজের এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানে খুব সতর্ক। মার্চ থেকে জুন মাস হচ্ছে এদের প্রজননকাল। কোন জলাশয়ের পাশের খাড়া ঢালে গর্ত করে বাসা বানায়। ৫- ৭টি ডিম পাড়ে। বাংলাদেশের সবখানেই মাছরাঙা আছে। এদেরকে ইংরেজিতে বলে Common Blue Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Alcedo atthis

২। সাদা বুক মাছরাঙা
লম্বায় ২৮ সে.মি। মাথা, ঘাড় ও পেট গাঢ় বাদামী রঙের। চিবুক, গলা ও বুকের উপর সবুজের আভা আছে। একটা কালচে পট্টি ডানার পাশে। ওড়ার পালক কালো, গোড়ার দিকে উপর সাদা ছোট। লম্বা ভারী সূচালো চঞ্চু, রং গাঢ় নিষ্প্রভ লাল। পায়ের রঙ রাল, নখর ধূসর। খাদ্য: ঘাসফড়িং, ঝিঝি পোকা, গঙ্গা ফড়িং, পিঁপড়ে, উই ইত্যাদি কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া-বিছে, তেঁতুলে বিছে, কেন্নে, কাঁকড়া, ব্যাঙ, টিকটিকি, গিরগিটি, ইঁদুর এবং ছোটখাটো অসুস্থ ও দুর্বল ও ছানা পাখি। মাছ প্রদান খাদ্য তালিকায় পড়েনা। তবুও এর নাম মাছরাঙা। বাংলাদেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইন্দোচীন, ফরমোজা ও ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত এই মাছরাঙাকে দেখা যায়। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে চারটি উপজাতি আছে। প্রত্যেকটা মাছরাঙা পাখির নিজস্ব এলাকা আছে। এই জায়গাটিতে অন্য কোন মাছরাঙার প্রবেশাধিকার নেই। কাছে এলেই তাড়িয়ে দেবে। জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসে ডিম পাড়ে। নদী বা খালের খাড়া পাড়ে গর্ত করে। চার থেকে সাতটি ডিম পাড়ে। বাচ্চা পালনসহ সংসারের সব কাজ স্ত্রী-পুরুষ দুজনে সমানভাবে করে। এদেরকে ইংরেজিতে বলে White breasted kingfisher, White-throated Kingfisher বা Smyrna Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Haleyn smyrensis.

৩। ছিট/পারকা মাছরাঙা
এর ইংরেজি নাম Pied Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Ceryle rudis। সাদা আর কালো পালকে মেশানো থাকে শরীর যার আকার প্রায় ১৭ সেমি।

৪। মেঘ হও মাছরাঙা
এরা ৩৫ সেমি দম লম্বা, গাছে বসে থাকে আর শিকার পেলেই ঝাপিয়ে পড়ে।এর ইংরেজী নাম Stork Billed Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Halcyon Capensis।

৫। লাল মাছরাঙা
এরা আকারে ২৫ সেমি এর মত হয়। পাগুলো তুলনা মূলক বড় ও বেশ শক্তিশালী। বাংলাদেশ ছাড়াও South Korea, Japan, China, India তে এদের দেখা মেলে। এর ইংরেজি নাম Ruddy Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Halcyon coromanda।

৬। সবুজ মাছরাঙা
এরা ঐধষপুড়হরফধব পরিবারের গেছো মাছরাঙা। এরা ইংরেজিতে Collared Kingfisher, White-collared Kingfisher বা Mangrove Kingfisher নামে পরিচিত। আর বৈজ্ঞানিক নাম Todiramphus chloris।

৭। বাদামী মাছরাঙা
বিশাল লাল ঠৌঁট। মাথা, গলা, পেটের দিক বাদামী হলুদ, পুচ্ছ ঘন বাদামী, পিঠ ও পাছা উজ্জল ফ্যাকাশে নীল। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে বিস্তৃত। বাদামী ডানা মাছরাঙার ইংরেজি নাম Brown-winged Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Pelargopsis amauroptera

৮। কালো মাছরাঙা
এদেরকে প্রধানত সেন্টমার্টিন ও উপকূলীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এর ইংরেজি নাম Black-capped Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Halcyon pileata ।

৯। বুনো মাছরাঙা
এর উপরের পালক ঘন নীল বা হালকা বেগুনী আর নিচের দিকের পালক কমলা হলুদ। ঠোটেঁর রঙ প্রবাল লাল আর পায়ে তিনটি আঙ্গুল। এর ইংরেজি নাম Oriental Dwarf Kingfisher আর বৈজ্ঞানিক নাম Ceyx erithacus।

সাতক্ষীরার শহরের রাজার বাগান এলাকার মো. খলিলুর রহমান বলেন, “আগে আমাদের পুকুরে ধারে চালা (গর্ত) করে মাছরাঙা পাখি বাসা করতো। সেখানে ডিম পেড়ে তা দিয়ে বাচ্চা হলো চলে যেত। এখানও বাসা তৈরি করে তবে আগের মতো না। এর কারণগুলো হলো ফসলে অধিক পরিমাণে কিটনাশক ব্যবহার গাছগাছালি কেটে ফেলে। এছাড়া এলাকার দুষ্ট ছেলের অনেক সময় গার্তের মধ্যে থেকে ডিম নষ্ট করে দেয়। মাছরাঙ্গা পাখি গাছের ডালে বসে থাকতো মাছা শিকার করতো। কিন্তু এখন আর খুব একটা চোখে পড়েনা।”

images

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক আবুল হোসেন বলেন, “আগে আমরা পুকুর পাড়ে মাছরাঙা পাখির মাছ শিকারের দৃশ্য নজরে পড়ত। শিকারের পর গাছের ডালে বসে মাছরাঙা শিকার করা মাছ খেত। এই দৃশ্য দেখে যে কারো হৃদয় জুড়িয়ে যেত। এই পাখিটি জলাশয়ের আশপাশে বেশি ঘোরাফেরা করে। কিন্তু দেশে নদী, নালা, খাল-বিলের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনেক মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে দিন দিন এই এই পাখিটি আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।”

আমাদের খাল বিল রক্ষা করা না গেলে বাঙালির প্রিয় খাবার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে মাছে ভাতে বাঙালি নামটিও মুছে যাবে। বিলুপ্তি হয়ে যাবে মাছ শিকারি মাছরাঙাও।

ছবি: সংগৃহীত

happy wheels 2

Comments