আমরা প্রত্যেকেই রোকেয়া

আমরা প্রত্যেকেই রোকেয়া

ঢাকা থেকে বাহাউদ্দীন বাহার

বছর তিনেক আগে বারসিক ‘আমিই রোকেয়া’ শিরোনামে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে। প্রতিটি স্তরে রয়েছে এক একজন নারী অগ্রদূত। তাকেই রোকেয়া হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল বারসিক। সত্যিই তো বাঙালি নারীদের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রায় এক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন কি শুরু এবং শেষ? না! এটি একটি চলমান দৌঁড়ের (রিলে রেস) মতো। কিংবা নারীদের সময়, পরিস্থতি, পরিপ্রেক্ষিত এবং সংগ্রামের পালাবদল ঘটছে নিত্য। কোন একটি কেন্দ্রিয় দৃষ্টান্ত দিয়ে বাঙালি নারীদের এগিয়ে যাওয়াকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তাইতো বারসিক বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তরে প্রতিটি ঘরে ঘরে একজন বেগম রোকেয়া খুঁজে বের করে তাদের সংগ্রাম এবং সফলতাকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৮ এর প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে বারসিক এর ‘আমিই রোকেয়া’ ক্যাম্পেইনের কেন জানি এক গভীর মিল। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “Time is Now: Rural and Urban Activists Transforming Women’s Lives”. ভাবার্থ করলে দাঁড়ায়- এখন সময় সেই সমস্ত কর্মীর; যারা তাদের সক্রিয় নানামূখী কর্মকান্ডের মাধ্যমে নারীর জীবনকে আমূলে বদলে দিচ্ছেন। এই সক্রিয় কর্মীরা যেমন শহরের ঠিক তেমন করে গ্রামেরও। সেই সক্রিয় কর্মীদেরকে স্কীকৃতি এবং সম্মান জানানোর এখনই উপযুক্ত সময়। এই কর্মীরাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো প্রত্যেকে এক একজন রোকেয়া। এই রোকেয়াদের নেই কোন লিঙ্গীয় পরিচয়। তারা লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম, শিক্ষা, পেশা, প্রভৃতির থেকে অনেক অনেক উর্দ্ধে। তাদের একটাই পরিচয়- তারা ইতিবাচক, প্রগতিশীল, উন্নয়নকামী।

Untitled-2.ai
২০০২ মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় আমার স্কুলে মাত্র ১টি মেয়ে ৩ কি.মি. সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতো। আমার বিশ্বাস তাকে সেই সময় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়েছে। এখন সেই একই স্কুলে কমপক্ষে ৫০ জন মেয়েকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে দেখি। ঐ এলাকার প্রেক্ষাপটে ঐ মেয়েটাই নিজের অজান্তেই কী বিশাল পরিবর্তন করেছে- সে হয়তো নিজেই জানে না। সেই মেয়েটা কি নারী অগ্রযাত্রার একজন সক্রিয় কর্মী না? অবশ্যই- সে একজন রোকেয়া!

কিংবা ভাবুন কলসুন্দরের সেই ফুটবল প্রেমী মেয়েগুলোর কথা। তাদের গল্প হয়তো নতুন নয়। কিন্তু তাদের হাত ধরেই আজ বাংলাদেশের অনুর্ধ্ব ১৫ নারী ফুটবল দলের সাফল্যে উচ্ছলিত সারা দেশ। সেই ছোট ছোট মেয়ে ফুটবলাররা কি এক একজন রোকেয়া নয়। তারা বাংলাদেশের নারীদের চিরাচরিত ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস এবং ভবিষ্যত চিন্তাকেই কি আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাই তো তারা প্রত্যেকেই এক একজন নারী উন্নয়নের সক্রিয় কর্মী।

নারী শ্রমিক! শব্দটি হয়তো এখন আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু ভাবুন তো বাংলাদেশের শ্রম ইতিহাসে নারীর অবস্থান। এখনও যেখানে প্রতি পদে পদে নারীরা তাদের কর্মস্থলে হাত, কথা, ইশারা, মজুরি, পরিবেশ, টয়লেট, প্রভৃতি প্রতিবন্ধকতাকে উড়িয়ে দিয়ে কিভাবে তার ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং দেশকে পরিবর্তন করছে- ধীরে ধীরে। সেই বিধবা এক সন্তানের দরিদ্র নারী শ্রমিক কি রোকেয়া নয়? একই সমান্তরালে গার্মেন্টস নারী কর্মী, কর্পোরেট নারী চাকুরিজীবী কিংবা কৃষি জমিতে নিড়ানিরত প্রত্যেক নারীই এক একজন রোকেয়া।

২০১৩ সালে রাজশাহীর নওদাপাড়া এলাকায় একটি মটর সাইকেল গ্যারেজে দুটি মেয়েকে মটরবাইক মেরামত শিখতে দেখেছিলাম। সেই সময়ে প্রতিদিন হয়তো অনেক নারীকেই মটর সাইকেল চালাতে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু একজন নারীকেও মটর সাইকেল মেকানিক হিসেবে দেখিনি। সেই মেয়ে দুটি সকল ধরনের বাক্সবন্দি চিন্তাকে গুড়িয়ে দিয়ে স্বপ্ন দেখছিল নতুন এক পেশাকে বেঁছে নেয়ার। সেই মেয়ে দুটি কি রোকেয়া নয়?

বাংলাদেশের নারীরা এখন কোন ক্ষেত্রে নেই? আকাশে উড্ডীয়মান বিমানের পাইলট থেকে বিশাল যাত্রীবাহী ট্রেনের চালক। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে কৃষক, প্রোগ্রামার থেকে চা বিক্রেতা আর রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ঘর পরিচালনা তো এখন পুরনো ফিরিস্তি।

নারী নিজেই বৈচিত্র্যের এক অদ্বিতীয় প্রতিনিধি। তাই তো বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের প্রতিটি পরতে পরতে এমন হাজারো রোকেয়ার অবদান ছড়িয়ে রয়েছে। এই লেখার সাথে যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে- সেটির দিকে একবার তাকালে বোঝা যাবে নারীদের উন্নয়নের আবহ। খুব অল্প কিছু চরিত্রকে এই ছবিতে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই চরিত্রগুলো অসংখ্য-  জ্বলজ্বলে আকাশের তারার মতো- অগণিত। এই ছবির কোন চরিত্রই কোন পরিচিত কিংবা কেন্দ্রীয় নয়। এরকম অগণিত অপরিচিত সক্রিয় কর্মীরাই নারীদের জীবন এবং কর্মধারাকে বদলে দিচ্ছে সারা পৃথিবীতে। এখনই সময় তাদেরকে স্বীকৃতি এবং সম্মান জানানোর।

“সময় এখন নারীর: উন্নয়নে তারা
বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরের কর্ম-জীবনধারা”

happy wheels 2

Comments