বন বৈচিত্র্য: পৃথিবীর জীবন্ত সত্তা

:: সিলভানুস লামিন

Untitledবিশ্বের মোট ভূন্ডের ৩১% হচ্ছে বন এবং এর পরিমাণ ৪ বিলিয়ন হেক্টর। বন আমাদের পৃথিবীর সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থান ধারণ করে; বন হচ্ছে নানা ধরনের পশু-পাখি এবং উদ্ভিদকনার নিরাপদ আবাস। আমরা যে খাদ্য খাই, যে পোশাক পরিধান করি, যেসব ঔষুধ খাই নিজেদের নিরোগ করার জন্য কিংবা যে আসবাবপত্র ব্যবহার করি এরকমই প্রায় ৫ হাজার পণ্যসামগ্রীর মূল যোগানদার হচ্ছে এই বন। শুধু কি তাই? বন মাটির ক্ষয়রোধ করে, জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে, বিশুদ্ধ পানি প্রদান করে। অন্যদিকে বনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়; আদিবাসীদের ধর্মীয় অনেক উৎসব বনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বন আমাদেরকে শিল্পকলায় আর্কষিত করে, গবেষণায় উৎসাহিত করে এবং সর্বোপরি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বের ৭ বিলিয়ন মানুষের ভালো থাকা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে এই বন। বনের গুরুত্ব অপরিসীম বলেই জাতিসংঘ ২০১১ সাল বন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে যেখানে ‘মানুষের জন্য বন” বিষয়বস্তুর ওপর কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী এ বছর বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে।

তবে বনের নানান অবদান ও উপকারিতার পরও বনাঞ্চল ধ্বংসের প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বব্যাপী। এ তথ্যানুযায়ী, বিগত ৮ হাজার বছরে বিশ্বের প্রায় ৪৫% বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে এর মধ্যে অধিকাংশই ধ্বংস হয়েছে বিগত দশকে, নিদির্ষ্ট করে বললে শিল্প বিপ্লব এবং আধুনিক কৃষির শুরুর পর থেকে। বনাঞ্চল ধ্বংসের হার এখন কিছুটা কমে গেলেও জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) হিসেব করে দেখেছে যে, বন ধ্বংসের কারণে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১৩ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল হারিয়ে যাচ্ছে, যার পরিমাণ লুক্সেমবার্গের আয়তন থেকে ১৩ গুণ এবং সিঙ্গাপুরের আয়তন থেকে ১৮০ গুণ বড়। বনাঞ্চল উজাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস থেকে বছরে ১৫% গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে বনে বাসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হওয়ার হার দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে; বিশ্বের ক্রান্তীয় বনাঞ্চলগুলোতে প্রতিদিন ১০০ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। বনাঞ্চল ধবংস বা উজাড় করার পরিণতি হিসেবে গত দশকে পৃথিবীতে ৩৫% ম্যানগ্রোভ বন, ৪০% ক্রান্তীয় বন এবং ৫০% জলাভূমি বিলুপ্ত হয়েছে। বনাঞ্চল হ্রাস হওয়ার কারণে প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি দ্রুতহারে হ্েছ। আইইউসিএন এর রেড লিস্ট (২০০৯) এর মতে, ৪৪,৮৩৭টি (ওই সংগঠন কর্তৃক তালিকাপ্রাপ্ত) প্রজাতির মধ্যে ৩৮% বিলুপ্তির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং এর মধ্যে ৮০৪ প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েগেছে।

কাঠ উৎপাদন বনের সবচে’ প্রধান কাজের মধ্যে একটি হিসেবে এতদিন বিবেচিত হয়ে আসলেও বর্তমানে এ ধারণাটি একটি বহুমূখী এবং নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অনুধাবন করা হয়েছে যে, মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখে এমন পণ্য ও সেবাসমূহের মূল উৎস হচ্ছে বন। বন থেকে মানুষের খাদ্যসহ ঔষুধ, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অনেক উপাদান ও উপকরণ পায়। এছাড়া মানুষ বন থেকে ঘরবাড়ি নির্মাণের উপকরণ ও জ্বালানি পায়। বন সুপেয় পানি সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ করে, পানি প্রবাহকে রক্ষা করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমন করে, মাটির ক্ষয়রোধ করে, মাটির পুষ্টি প্রদান করে, কার্বনের মজুদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির জন্য অনুকূল পরিবেশ ও আধার তৈরি করে। অন্যদিকে জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনীতিতে বন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে; প্রত্যক্ষভাবে বলা যায় বিভিন্ন আয়ের মাধ্যমে, মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কিংবা বন খাত কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে। অন্যদিকে পরোক্ষভাবে বলা যায়, বন থেকে সেবা বিশেষ করে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে পানি সরবারাহের মাধ্যমে বন অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। বনজ সম্পদের ওপর বিশ্বের মানুষের নির্ভরশীলতার হার কোন অংশে কম নয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী,বিশ্বের ১.৬ বিলিয়ন মানুষ কাঠ, কাঠ বর্হিভূত বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী আফ্রিকার ৮০% মানুষ স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক উপকরণ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ঔষুধের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) ওপর নির্ভর করে এবং বিশ্বের এক বিলিয়ন মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য বনের গাছগাছড়া থেকে তৈরি ওষুধসামগ্রী ব্যবহার করে। উপরোক্ত হিসাব থেকে বলা যায়, মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনায়নে বনপ্রাণবৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অন্যদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক যেসব গবেষণা পরিচালিত হয়েছে সেগুলোতে বলা হয়েছে যে, প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেশ, প্রজাতি এবং জেনেটিক বৈচিত্র্যের অস্তিত্ব মানুষের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও যত্ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি প্রদান, সংক্রামক ও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই প্রতিরোধ এবং দুর্যোগজনিত বিভিন্ন ঝুঁকি হ্রাস করতে এসব প্রাকৃতিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা রাখে।

বনজ ভূুমিগুলোকে কৃষিজমিতে রূপান্তর, বন থেকে অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ, বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ (আকাশিয়া, ম্যানজিয়াম, ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি) ও প্রাণীর প্রর্বতন, মনোকালচার, অনিয়ন্ত্রিত জুম চাষ, অস্থায়িত্বশীল বনব্যবস্থাপনা, বনভূমি উজাড় করে অবকাঠামো নির্মাণ (রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদুৎ উৎপাদনের জন্য স্থাপনা, নগরায়ন), খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য বনভূমি উজাড় করে খনন কাজ, জনসংখ্যার চাপ, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বন ও বনপ্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই বন বনপ্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে দরকার স্থায়িত্বশীল বনব্যবস্থাপনা এবং বনজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার। স্থায়িত্বশীল বন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হলে মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কল্যাণ যেমন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে তেমনি বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি আসবে। কারণ বনাঞ্চল উজাড় ও ধবংস বন্ধ করা গেলে প্রায় ১৫% গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করা যাবে। এজন্য বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বনাঞ্চল উজাড় ও বনাঞ্চল ধবংস (Reducing emissions from deforestation and forest degradation-REDD এবং REDD+) এর অধীনে নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সিবিডি নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০২০ সালের মধ্যে বনাঞ্চল ধবংসের হার অর্ধেকে কমিয়ে আনা, যেখানে সম্ভব, সেখানে এই হারকে শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংস হওয়া মোট বনাঞ্চলের ১৫% নতুন করে সৃষ্টি করা। এছাড়া সংরক্ষিত এলাকার আয়তন মোট ভূখ-ের ১৭%-এ উন্নীত করা এই কৌশলগত পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্যার্জনের জন্য সরকারের চূড়ান্ত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা জরুরি যেখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সুশীল সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাসহ সব পর্যায়ের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

happy wheels 2

Comments