সাম্প্রতিক পোস্ট

দেবহাটার টাউন শ্রীপুর পৌরসভার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও বিলীনের পথে

দেবহাটার টাউন শ্রীপুর পৌরসভার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও বিলীনের পথে

সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম

হারিয়ে যেতে বসেছে দেবহাটা উপজেলার টাউন শ্রীপুর পৌরসভার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও। সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হতে চলেছে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত টাউন শ্রীপুর পৌরসভা। দেশ ভাগের পর থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে। জমিদারি শাসনামলের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় জমালেও সংরক্ষণের নেই কোন উদ্যোগ।

ইছামতি নদী তীরবর্তী সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা দেবহাটা। এখানে রয়েছে হাজারও বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম নিদর্শন টাউন শ্রীপুর পৌরসভা বা দেবহাটা মিউনিসিপ্যাল অফিস।

Town Sreepur Municipal Office (1)

দেবহাটা মিউনিসিপ্যাল অফিস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৭ সালে। তৎকালীন সময়ে খুলনা বিভাগের প্রথম পৌরসভা ছিল এটি। ১২ জন জমিদারের বাস ছিল টাউন শ্রীপুর গ্রামে। মূলত এটি এলাকার উন্নয়নের কাজে ও বিচারালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রথমে গ্রামটির নাম ছিল শ্রীপুর। পৌরসভা, অবকাঠামো (রাস্তা), রাস্তার বাতি, সুপেয় পানি, জুনিয়র স্কুল থাকার কারণে পরবর্তীতে এর নাম দেওয়া হয় টাউন শ্রীপুর। ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে মেটাল রোডও (সুরকি দিয়ে ঢালাইকৃত) ছিল।

ব্রিটিশ শাসনামলে টাউন শ্রীপুর গ্রামে পৌরসভার পক্ষ থেকে গ্যাস পোস্টের মাধ্যমে রাস্তায় বাতি জ্বালানো হতো। এই রাস্তায় জমিদারদের চলাচল ছিল এজন্য সন্ধ্যার পর পেয়াদারা বাতিগুলো জ্বালাতো।

ব্রিটিশ শাসনামলে কনক কান্তি সরকার পৌরসভার পক্ষ থেকে সুপেয় পানির জন্য একটি পুকুর খনন করেন। পৌরসভার মানুষ খাবার পনি হিসেবে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতো। টাউন শ্রীপুর পৌরসভার মানুষ পুকুরটিকে পানির রিজার্ভ ট্যাংক হিসেবে অভিহিত করতো।

যতদূর জানা যায়, দেশ বিভাগের পর টাউন শ্রীপুর পৌরসভার কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভবত ১৯৫১-১৯৫২ সালের দিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই স্থগিতাদেশ জারি করে। এরপর পৌরসভাটি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এটি পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

টাউন শ্রীপুর পৌরসভায় রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম নিদর্শন কারুকার্য খচিত একটি প্রবেশ দ্বার। যেটি প্রায় ধ্বংসের পথে। প্রবেশ দ্বার এবং স্মৃতিফলক দেখেই বোঝা যায় এর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা।

পৌরসভায় আরও রয়েছে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত তারকাখচিত একমাত্র পুরাতন ভবন। এটি ব্রিটিশ শাসনামলে বিচারালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভবনের নকশা ও পলেস্তার খসে খসে পড়ছে। সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে এর অবয়ব। এর অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে।

টাউন শ্রীপুর শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির সাবেক শিক্ষক দিলীপ কুমার ব্যানার্জি বলেন, “টাউন শ্রীপুরে মোট জমিদার ছিল ১৩ জন। এর মধ্যে বড় জমিদার ছিল ৭জন। সবচেয়ে বড় জমিদার ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ রায় সরকার। সর্বশেষ জমিদার ছিলেন বলহরি সরদার, অরবিন্দু সরদার ও বৈদ্য নাথ সরদার। টাউন শ্রীপুর পৌরসভাটি ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি স্বচোখে দেখেছি পৌরসভার পেয়াদারা গ্যাস পোস্টের মাধ্যামে রাস্তায় বাতি জ্বালাতো। পুরো পৌরসভায় জ্বলতো এই বাতি। সুপেয় পানির জন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে একটি পুকুরও খনন করা হয়েছিল। এই পুকুরকে পানির রিজার্ভ ট্যাংক বলা হতো।”

তিনি আরও বলেন, “প্রথমে গ্রামটির নাম ছিল শ্রীপুর। শিক্ষা ও অবকাঠামোর (রাস্তা) দিক থেকে শ্রীপুর ছিলো এগিয়ে। তাই পরবর্তীতে এর নাম রাখা হয় টাউন শ্রীপুর। এখানে মেটাল রাস্তাও ছিল।”

দেবহাটা ইউনিয়িন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বকর গাজী বলেন, “ব্রিটিশ শাসনামলে খুলনা বিভাগের মধ্যে টাউন শ্রীপুর পৌরসভা ছিল প্রথম। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এটি বিচারালয় হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। দেশ বিভাগের পর সম্ভবত ১৯৫২ সালের দিকে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে ভবনটি পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “পৌরসভার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় এর কার্যক্রম ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কয়েকবার কলকাতার হাইকোর্টে মামলা করা হয়। এতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি।”

বর্তমানে টাউন শ্রীপুর পৌরসভার অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে। প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর এই নিদর্শন সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

happy wheels 2

Comments