নোবেল বিজয়ী ড. অমর্ত্য সেন এই বাড়ির ছেলে

নোবেল বিজয়ী ড. অমর্ত্য সেন এই বাড়ির ছেলে

ঘিওর, মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক।।
মানিকগঞ্জ শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম মত্ত। এলাকার বিশাল উচ্চতার মত্ত মঠের নজর কাড়ে বহুদূর থেকেই। মঠের ঠিক পেছনে টলমলে জলের বিশাল একটি দিঘি। দিঘির চারপাশ আগাছা আর জঙ্গলে ভরপুর। এর উঁচু দক্ষিণ পাড় এখন পিচঢালা পথ। এ পথের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকে তাকালেই নজর পড়ে চারদিকে জরাগ্রস্ত ডজনখানেক কাঁচা-পাকা টিনের ঘর। আর বাড়ির আঙিনায় মেহগনি গাছের বাগান। একসময় জজবাড়ি হিসেবেই বাড়িটিকে চিনতেন এলাকার মানুষ। তবে জজবাড়ির একটি ইট-কাঠও আজ অবশিষ্ট নেই। হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সবাই ভুলে গেছে জজ বাড়ির নাম। মানিকগঞ্জ পৌরসভার এ গ্রামেই শিকড় প্রত্থিত রয়েছে দেশ এবং জগৎখ্যাত একজন মানুষের। এ বাড়ির সন্তান বাঙালির গর্ব নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন। মঠটির ৩০০ গজের মধ্যেই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী ড. অমর্ত্য সেনের বাড়ি।

manikgonj 4এ গ্রামটিতে একসময় প্রতাপশালী জমিদারদের বসবাস ছিলো। তাদের মধ্যে রামকৃষ্ণ সেন এবং তার ছেলে প্রসন্ন কুমার সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তির ইতিহাসে মত্ত গ্রামের গুপ্ত পরিবারের অবদানের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এ পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন শিবানন্দ গুপ্ত। শিবানন্দ গুপ্ত > প্রভাস গুপ্ত> শিশির গুপ্ত থেকে প্রবোধ গুপ্ত পর্যন্ত মোট ২৩ পুরুষের সন্ধান পাওয়া যায়। গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা শিবানন্দ গুপ্ত নামকরা কবিরাজ ছিলেন। তিনি পাঠান সেনাপতি মীর মকিমের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। অনুমিত হয় যে, বাংলাদেশে পাঠান শাসনামলে মত্তের গুপ্ত বংশীয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ এ এলাকায় যেমন বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো তেমনি ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রে তাদের অগাধ ব্যুৎপত্তি প্রবাদের মতো লোকমুখে আজও উচ্চারিত হয়।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের ক’বছর আগে জজবাড়ির লোকেরা অনেক স্মৃতি, অনেক মায়া পিছনে ফেলে ভারতে চলে যান। হতদরিদ্র ইদ্রিস আলী, ময়জুদ্দিন ও শুক্কুরী বেগমের মতো ১০-১২টি দরিদ্র ভূমিহীন পরিবার এখন ওই বাড়ির মালিক। পেশায় এদের কেউ ভ্যানচালক, আটোবাইক চালক আবার কেউ দিনমজুর, ক্ষুদ্র দোকানি। এদের অনেকে জানেন না এ বাড়ির জজ সাহেবের ইতিকথা। বোঝেন না নোবেল পুরস্কার, বোঝেন না অর্থনীতি, আর জানেনও না অমর্ত্য সেনকে।

১৯১৮ সাল থেকে ১৯২০ এর মাঝামাঝি সময়ে সারদা প্রসাদ সেন বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন দেওয়ান বাহাদুর উপাধি। পেশায় ছিলেন সেশন জজ। তার ছোট ভাই অন্বিকা প্রসাদ সেনও ছিলেন সাবজজ। আর এ কারণে তাদের এ বাড়িটি সবাই জজবাড়ি বলতো। সারদা প্রসাদের ছেলে বিলেত পড়া আশুতোষ সেন শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ‘নটির পূজা’ নাটকটি দেখতে। নাটকের অভিনেত্রী অমিতাকে ভালো লেগে যায় তার। সিদ্ধান্ত নেন তাকেই জীবনসঙ্গী করবেন। বাবাও অমত করেননি। সেই সুবাদে অমিতাকে বিয়ে করে আশুতোষ সেন ফিরে আসেন মানিকগঞ্জের ওই মত্ত গ্রামে। নতুন বউ দেখতে সেদিন পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছিল জজবাড়ির উঠানে।

manikgonj 3এই আশুতোষ সেন আর অমিতা সেনের ঘরেই জন্ম নিয়েছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নোবেল জয়ী ড. অমর্ত্য সেন। সে সময়ের আলোচিত জজবাড়িতে ছিল ৭-৮টি নকশাদার দৃষ্টিনন্দন টিনের ঘর, ছিল নজরকাড়া পূজাম-প। চাকরি সূত্রে জজবাড়ির দুই জজ ভাই বাইরে থাকলেও তাদের বাবা মা স্থায়ীভাবেই থাকতেন এ বাড়িতে। আর অমর্ত্য সেন নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে ঢাকার ওয়ারীর বাড়িতে বড় হয়েছেন। অমর্ত্য সেনের বাবা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। দেশ ভাগের পরে আশুতোষ সেন দিল্লিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। তবে বিভিন্ন উৎসব, পূজা পার্বণের ছুটি পেলেই বাবা-মায়ের সঙ্গে ছুটে আসতেন অমর্ত্য সেনও। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ক’বছর আগে জজবাড়ির লোকেরা অনেক স্মৃতি, অনেক মায়া পিছনে ফেলে ভারতে চলে যান।

এসব তথ্য বলবার মত বয়েসী মানুষ মত্ত গ্রামে আজ আর বলতে গেলে একজনও নেই। যা বলবার তা বলছিলেন, এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ৯০ পেরুনো সবারপ্রিয় মাস্টার মশাই। ৮৮’র বন্যার আগে, অমর্ত্যসেন যখন বিশ্বখ্যাতি পাননি তখন একবার হঠাৎ করেই নাড়ির টানে পূর্ব পূরুষের ভিটেমাটির স্পর্শ নিতে মত্ত গ্রামে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন পাশের বাড়ির চিরকুমার মাস্টার মশাই।

Manikgonj 1

অমর্ত্য সেন সেদিন ঘুরে ঘুরে হেঁটেছেন যেখানে ছিল তার বসতবাড়ি, পূজামন্ডপ, স্বপ্নময় উঠোন। পরম মমতায় হাত বুলিয়েছেন সেখানে বসবাসরত ইদ্রিস আলীর লাগানো লাউয়ের ডগায়। এক সময়ের আলোচিত জজবাড়ি এখন অর্পিত সম্পত্তি। কথা হয়েছিল তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ছিন্নমূল মানুষগুলোর সঙ্গে। ড. অমর্ত্য সেনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ৭০ বছরের বৃদ্ধ ময়জুদ্দিন জানালেন, “অমর্ত্য সেন সর্বশেষ যেদিন মত্ত গ্রামে তাদের বাড়িতে এসেছিলেন সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি বাড়িটি ফিরিয়ে নিতে আসিনি। শুধু বাবার ভিটা দেখতে এসেছি।” ময়জুদ্দিন আরো বলেন, “ভিটেমাটিহীন ছিলাম বলেই স্বাধীনের কয়েক বছর আগে এই বাড়িতে একটি ঝুপড়িঘর তুলে বসবাস করে আসছি। প্রতি বছর সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে এখনো থাকতে হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের বাড়ি হওয়ায় প্রায় প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে আসেন। দেখে আবার চলে যায়। এ বাড়িতে থাকতে পেরে আমরাও গর্বিত। সবার কাছে গর্ব করে বলতে পারি আমরা বিশ্বখ্যাত নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়িতে থাকি।” আবার বর্তমানে এই বাড়িতে আশ্রয় নেয়া অনেকে জানেন না এ বাড়ির জজ সাহেবের ইতিকথা। বোঝেন না নোবেল পুরস্কার, অর্থনীতি। আর জানেনও না অমর্ত্য সেন কে?

অধ্যাপক সেনের খুবই ঘনিষ্ঠ ও স্নেহভাজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের খুবই আপন একজন মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, আমাকেই সঙ্গে নিয়ে তাদের ওয়ারীর বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলেন।’’ তার স্মৃতি তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ছায়াঢাকা-পাখিডাকা জন্মভূমি মানিকগঞ্জে। যে বাড়িতে তার শৈশবের অনেকগুলো দিন কেটেছে।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ১৯৯৮ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। অর্থনীতিতে এই পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে অমর্ত্য সেন প্রথম এশিয়া, প্রথম উপমহাদেশীয়-সর্বোপরি প্রথম বাঙালি হিসেবে এই তালিকায় নিজের নাম লেখান। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ৩ কন্যা ও ১ পুত্রের জনক। তার স্ত্রী এমা রস চাইল্ড একজন ফরাসী নাগরিক। স্ত্রী এমাই প্রথম তাকে ফোনে নোবেল পুরস্কার লাভের খবর জানান। শৈশবের দূরন্ত দিনগুলো অমর্ত্য সেন কাটিয়েছেন মানিকগঞ্জ আর ঢাকাতে। বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকে নিয়ে মত্ত গ্রামের মানুষ গর্ববোধ করবেন জন্মজন্মান্তর।

প্রাচীন স্থাপনাগুলো আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক। আমাদের অতীত গৌরবের সাক্ষী। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। এর জন্য উদ্যোগী হতে হবে সরকারকেই। অবহেলা-ঔদাসীন্যে ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হওয়া শুধু দুঃখজনকই নয়, জাতি হিসেবে আমাদের জন্য চরম অগৌরবজনকও।

happy wheels 2

Comments