মথি ঘাগ্রার পথচলা

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা

কলমাকান্দা উপজেলার লেংগুরা ইউনিয়নের তারানগর গ্রামের বাসিন্দা মথি ঘাগ্রা। কৃষিকাজই তাঁর প্রধান পেশা। ছেলে মেয়ের লেখা পড়া ও সংসারের যাবতীয় খরচ সবই কৃষিকাজের উপর নির্ভর করে তার সংসার চলে। কৃষির প্রতি তার আগ্রহের কোন শেষ নেই, আগ্রহের কমতি নেই নতুন কোন কিছু শিখার! এমন করে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন নিজ তাগিদে। কৃষির উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের, এমনকি নেপালেও গেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কৃষির কাজের অভিজ্ঞতার নতুন মাত্রা যোগ করতে। সেখানে শিখে এসেছেন কিভাবে কৃষির ক্ষেত্রে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কিভাবে সারাবছর সব্জি চাষ করতে হয় ও কিভাবে বস্তায় সব্জিচাষ করতে হয় সেসব বিষয় শিখে আসছেন।

dsc01698
বস্তায় মরিচ চাষে সফল হয়েছেন মথি ঘাগ্রা। তিনি আজ থেকে ৩ বছর আগে থেকে শুরু করেছেন বস্তায় মরিচ চাষ। শুরুতে তিনি ৪ জাতের মরিচের চাষ করেছিলেন কিন্তুবর্তমানে ২ জাতের মরিচ তাঁর বাগানে আছে। বস্তা সংগ্রহ করে বস্তার ভেতর মাটি, গোবর ও কেঁচো কম্পোষ্ট ভালো করে মিশিয়ে সেগুলো বস্তার অর্ধেক পরিমাণ ভরে সেখানে রোপণ করেন মরিচ গাছ। আর সেই মরিচ গাছগুলো আজো রয়ে গেছে তার উঠানে। এভাবে তিনি ১৪টি বস্তায় মরিচ গাছ রোপণ করেছিলেন যেখান থেকে তিনি প্রতিদিনের মরিচের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন। তিনি ৩ বছর যাবৎ বাজার থেকে মরিচ কিনছেন না। তাঁর বাগানের মরিচ দিয়েই নিত্যদিনকার মরিচের চাহিদা পূরণ করছেন। সেই সাথে আশপাশে থাকা আত্মীয় স্বজনেরাও মাঝে মধ্যে তার কাছ থেকে মরিচ নিয়ে মরিচের চাহিদা পূরণ করছেন। ১৪টি মরিচ গাছের মরিচ তার পরিবারের চাহিদা পূরণের পরও আরো যেটুক থাকে তা শুকিয়ে রাখেন। এভাবে তিনি প্রতিবছর প্রায় ৫ কেজি মরিচ শুকিয়ে রাখতে পারেন।

সংসারের সব কাজের ফাকে করছেন নার্সারিও। মরিচ ও পেঁপে চারা করে বাজারে বিক্রি করছেন দুই বছর যাবৎ। প্রতিবছর এই নার্সারি থেকে তিনি আয় করছেন ৮-১০ হাজার টাকা। শুধুমাত্র পেঁপে ও মরিচের চারা মৌসুমে একবারই করা হয়ে থাকে অন্যান্য সময়ে বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তবে এবছর পেয়ারা চারা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।

জৈব সার ও জৈব কীটনাশকের ব্যবহার করছেন আজ থেকে প্রায় ৭ বছর আগে থেকে। মাটির গুণাগুণ ঠিক রাখা ও পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে থেকে ফসলকে রক্ষা করতে জৈব পদ্ধতিতে কৃষি কাজ করে চলেছেন মথি ঘাগ্রা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শিখেছেন জৈব সার তৈরি ও জৈব বালাইনাশক তৈরির কৌশল। আর সেই প্রশিক্ষণে শেখা সেই কৌশলই কাজে লাগিয়ে কাজ করে চলেছেন অবিরত। এভাবে বিগত দুই বছর কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে নিজে ব্যবহার করছেন ও বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে কেঁচো কম্পোস্ট বিক্রি করছেন এই দুই বছর যাবৎ। এভাবে তিনি কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে কেঁচো সার বিক্রি করে আয় করছেন প্রতিবছরে প্রায় ৬ হাজার টাকা। নিজে কম্পোস্ট করছেন অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করছেন। এমনকি যারা কেঁচো কম্পোস্ট করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন তাদেরকে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির কলা কৌশল শিখাচ্ছেন এবং কেঁচো কম্পোস্ট স্থাপনে সহযোগিতা করছেন। এভাবে জৈব কৃষি চর্চা নিজে করছেন ও অন্যকেও সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

dsc01699
কৃষিই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তাই তো নতুন কিছু শিখতে ও জানতে তিনি পিছপা বা সংকোচ বোধ করেন না কখনো। ধানের ব্রিডিং নিয়ে আগ্রহ ও কৌতুহল ছিল অনেকদিন আগে থেকেই কিন্তু পারছিলেন না পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে। তাই একদিন সুযোগ পেয়ে ব্রিডিং এর উপর কর্মশালায় অংশ নেন, হাতে কলমে শেখেন কৌশলটি। তারপর থেকে দু’টি জাত হাতি বান্দা ও সোহাগ-৪ এই দুটি ধানের সংমিশ্রণে নতুন জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ বছর এফ ২ তে পদার্পন করেছেন। এভাবে এবারও আরো একটি নতুন ব্রিডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

কৃষি কাজকে ভালোবাসেন বলে কঠোর প্ররিশ্রম করেন প্রতিদিন। প্রতি মৌসুমে বিভিন্ন শাকসব্জি চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করছেন পাশাপাশি উদ্বৃত্তগুলো বিক্রি করে আয় করছেন। সব্জি ও বীজের জন্য বাজারের উপর নির্ভর না করে নিজে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করছেন। অনেককে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি কাজের ক্ষেত্রে। তার পরামর্শে কৃষিকাজ করে অনেকে সুফলও পাচ্ছেন। তাঁর কথা হলো, শিক্ষাটা শুধুমাত্র নিজের মধ্যে রাখলে চলবে না; অন্যদের মাঝেও বিলিয়ে দিতে হবে। তাই যেই তাঁর কাছ থেকে পরামর্শের জন্য আসছেন তাকেই সহযোগিতা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

happy wheels 2