সবুজ সংহতি: বাংলাদেশে কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, জলবায়ু সুবিচার ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব আন্দোলনের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক
সিলভানুস লামিন
বারসিক ২০২৪ সালে ‘সবুজ সংহতি’ নামে একটি নেটওয়ার্ক চালু গঠন করেছে। এই সংহতির লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে কৃষিপ্রতিবেশ চর্চা, জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং খাদ্য সার্বভৌমত্বের আন্দোলনকে শক্তিশালী করা। এই নেটওয়ার্কে সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, নারী, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষাবিদ, পরিবেশ রক্ষাকারী এবং এমনকি স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও। ইতোমধ্যে বারসিক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোয়ালিশনের কমিটি গঠন করেছে, যা এই নেটওয়ার্কের প্রসার এবং প্রভাব বাড়াতে সহায়তা করছে।
একটি গবেষণা ও উন্নয়নমুখী সংগঠন হিসেবে বারসিক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। বারসিকের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো স্থানীয় ও লোকায়ত জ্ঞানের নথিভুক্তকরণ, যাতে মূলধারার উন্নয়নে এই জ্ঞানের গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বারসিক বিগত বছরগুলোতে থেকেই বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী ও অভিযোজন চর্চাসমূহ নথিভুক্ত করেছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে করেছে তা প্রতীয়মান হয়েছে।
কিন্তু দুঃখের সাথেই বলতে হয়, এসব স্থানীয় ও লোকায়ত জ্ঞানভিত্তিক চর্চা প্রায়শই মূলধারার উন্নয়ন এজেন্ডা থেকে উপেক্ষিত থাকে, যেখানে উপর থেকে চাপানো পদ্ধতিই বেশি প্রাধান্য পায়। অনেকসময় এই তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোই প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসায়নিক কৃষি, একফসলি চাষ এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ যেমন নদী দখল ও বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে প্রকৃতির ক্ষতি করছে অন্যদিকে, মানুষের সীমাহীন লোভ প্রকৃতির নানা সৃষ্টিকে তথা গাছপালা, লতা, বন, নদী ও জলাশয়কেও বিপন্ন করে তুলেছে। দেখা যায়, অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মানুষেরাই এসব কাজ বেশি করছেন।
এই অপরিকল্পিত ও পরিবেশিবিনাশী কার্যক্রমগুলোর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবহাওয়ার ঋতু পরিবর্তন কৃষি চক্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। কৃষকেরা এই পরিবর্তিত অবস্থায় ফসল ফলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রতিবছর বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জলাবদ্ধতার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে, যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক দুর্দশার সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু ন্যায়বিচারের জরুরি প্রয়োজন
জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখনও টিকে আছে। তবে যে হারে পরিবেশ ধ্বংস, রাসায়নিক কৃষি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পরিবেশ ধ্বংস ও অনিরাপদ কৃষি চর্চা
উচ্চ ফলনের আশায় বাংলাদেশের বেশির ভাগ কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। শিল্পবর্জ্যে নদী ও জলাভূমি দূষিত হচ্ছে। আর জলাশয় ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণের কারণে নদী-খাল মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে। জলজ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসসহ বহু মাছ ও প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটিয়েছে, যা পরিবেশ ও খাদ্য শৃঙ্খলের জন্য বিপজ্জনক।
এছাড়া কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে উপকারী পাখি, মৌমাছি, পোকার মতো পরাগায়নকারী প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি হয়। ভয়াবহ তথ্য হলো, ২০১৬ সালে নিষিদ্ধ হওয়া কার্বোফিউরান এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে (সমকাল, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। এই বিষাক্ত উপাদান নানা জটিল অসংক্রামক রোগ, বিশেষ করে ক্যান্সারের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪০,০০০ মেট্রিক টন কৃষি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকা। কৃষকেরা এখন মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৫০% পর্যন্ত খরচ করেন এসব রাসায়নিক দ্রব্য কিনতে। ২০২২ সালে দেশে ৮.৮ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হয়েছে। এতে করে দেশের ৭৬.২% আবাদি জমি এখন মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত, যা মাটি সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI) এর প্রতিবেদনেও উল্লেখ আছে। রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বিগত বছরগুলোতে প্রায় ১.১২৪ কোটি হেক্টর জমি হ্রাস পেয়েছে। শুধু ২০০০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১.০৭ আবাদযোগ্য জমির হ্রাস পেয়েছে। এই হার চলতে থাকলে আগামী ৬৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমি একেবারেই বিলীন হয়ে যেতে পারে।
কৃষকের দুর্দশা: ঋণ, জমি ক্ষয় ও শোষণ
রাসায়নিক কৃষি চর্চার কারণে কৃষকেরা প্রায়ই এনজিও কিংবা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ফসল উৎপাদন করেন। ফসল ঘরে তোলার পর কম দামে বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হয়। ফলে পরিবারের জন্য খুব অল্প পরিমাণ ফসলই রেখে দিতে পারেন। আরেক বিপজ্জনক প্রবণতা হলো, ইটভাটার জন্য কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কেটে নেওয়া, যা মাটির প্রাকৃতিক গঠন ও প্রাণবৈচিত্র্য চিরতরে নষ্ট করে দেয়। তাই কৃষি কাজ করে কৃষকরা এখন আর লাভবান তো হচ্ছেনই না; উপরোন্তু রাসায়নিক কৃষি চর্চার কারণে মাটিও তার উর্বরশক্তি হারিয়েছে; হারিয়েছে প্রকৃতির প্রাণবৈচিত্র্য এবং বিলুপ্ত হয়েছে আরও কোটি কোটি প্রাণ।
দূষিত জমি, পানি ও জীবন
গ্যাস ট্যাবলেট (অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড) দিয়ে মাছ ধরা জলজ প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। কীটনাশক ও সার ব্যবহারের ফলে মানুষ, প্রাণী, জমি, পানি ও ফসল সবকিছুই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। কিডনি, লিভার, ফুসফুসের রোগ, জন্মগত ত্রুটি এবং ক্যান্সার রোগ বাড়ছে। ঢাকা জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের ৬৪% কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন পরামর্শক জানিয়েছেন, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শের কারণে অনেক কৃষক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। তার মতে, কৃষিজীবী ক্যান্সার রোগীদের ৬০% এর কারণ এই বিষাক্ত রাসায়নিকের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার।
নারী স্বাস্থ্য হুমকির মুখে
নারীদের জন্য এই বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো বিশেষ করে গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। গর্ভপাত ও জন্মগত ত্রুটির ঘটনাও বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ধ্বংস
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অকাল বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, ঘন কুয়াশা ইত্যাদিতে কৃষি ও জীবিকা বিপর্যস্ত হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও জ্বালানিনির্ভর সেচ ব্যবস্থায় কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে।
পানির সংকট ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব
বরেন্দ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অনেক কিশোরী মাসিক বিলম্ব করতে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাচ্ছে, যা তাদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। একদিকে পানির অভাবে বরেন্দ্র অঞ্চল ও হাওর-উপকূলের মানুষদের খাদ্য অনিরাপত্তা, বেকারত্ব, বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসনের সংখ্যা বাড়ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে সংঘাতও বাড়ছে। সম্প্রতি পানি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে দুইজন আদিবাসী কৃষক আত্মহত্যা করেছেন।
বারসিকের উদ্যোগ: সবুজ সংহতির মাধ্যমে ঐক্যতা তৈরি
বারসিক প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস, রাসায়নিকের অপব্যবহার এবং পরিবেশ ধ্বংস প্রতিরোধে কাজ করছে। কিন্তু এই বিশাল কাজ এককভাবে কোনো সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। সবুজ সংহতি এই সম্মিলিত উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দু। এর সদস্যরা সচেতনভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় একযোগে কাজ করছেন।
সবুজ সংহতির উদ্দেশ্য
- পরিবেশ ধ্বংস রোধ
- প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ
- বায়ু, মাটি ও পানিদূষণ রোধ
- সব প্রাণসমূহের পারস্পরিক নির্ভরতা ও সম্মান নিশ্চিতকরণ
- পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
- সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক আন্দোলন
- কৃষি-প্রতিবেশবিদ্যা চর্চা কেন্দ্রিক খাদ্য সার্বভৌমত্ব উন্নয়ন
- জলবায়ু সুবিচারের জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা
তথ্য কেন্দ্র হিসেবে সবুজ সংহতি
তথ্য মানেই ক্ষমতা, বিশেষ করে পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। সঠিক, সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক তথ্যের অভাবে অনেক সময় মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে এবং নিজেদের পরিবেশ রক্ষা করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এই প্রেক্ষাপটে, সবুজ সংহতি একটি তথ্য কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে, যেখানে পরিবেশ আইন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নীতিমালা, কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন পরিবেশগত হুমকি ও ঝুঁকি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচার করা হয়। এই তথ্য কেন্দ্র মানুষকে পরিবেশ ধ্বংসের মূল কারণ ও তার পরিণতি বুঝতে সহায়তা করে, পাশাপাশি এসব মোকাবেলায় বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা সম্পর্কেও সচেতন করে। সবুজ সংহতি গবেষণা, ক্ষেত্রভিত্তিক অনুসন্ধান, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ এবং সাহিত্য পর্যালোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। এছাড়া, এটি স্থানীয়ভিত্তিক, দীর্ঘদিনের প্রমাণিত পরিবেশবান্ধব চর্চা যেমন কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, প্রাকৃতিক কৃষি, জৈব কৃষি এবং জলবায়ু অভিযোজন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় লোকায়ত জ্ঞান ব্যবস্থার নথিভুক্ত করে। এই মূল্যবান জ্ঞান ও তথ্য স্থানীয় মানুষ, সুশীল সমাজ ও অন্যান্যদের সাথে সহভাগিতা করে সবুজ সংহতি একটি পরিবেশ সচেতন ও তথ্যভিত্তিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তি ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তথ্যভিত্তিক, বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করে এবং পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করবে, যা সার্বিকভাবে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা প্রদানে সবুজ সংহতি
অনেক সময় প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত মানুষও পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান এবং নীতিগত কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত নন। অধিকাংশ মানুষ এখনো জানেন না বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (BCCSAP), জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP), পরিবেশ আইন ও বিধি এবং প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (যেমন Convention on Biological Diversity বা CBD) সম্পর্কে। পরিবেশবান্ধব কৃষি বা কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চা, জলবায়ু অভিযোজন অথবা প্রতিবেশভিত্তিক সহনশীলতা নির্মাণ এবং সচেতনতা তৈরি করার মতো স্থায়িত্বশীল চর্চাও অনেকের কাছেই অপরিচিত। এই জ্ঞানের ঘাটতি পূরণে সবুজ সংহতি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, যেখানে মানুষের পরিবেশ-সংক্রান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতাকে নীতি কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করার কাজ করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ, প্রশিক্ষণ, সংলাপ ও সচেতনতামূলক সেশনের মাধ্যমে এটি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবী, যুবক-যুবতী, নারী, উন্নয়নকর্মী এবং স্থানীয় নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এসব সেশন পরিচালনা করেন অভিজ্ঞ শিক্ষক, গবেষক, বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন কৃষক এবং বারসিকের সিনিয়র স্টাফগণ, যাঁরা অংশগ্রহণমূলক ও সহজভাবে এসব বিষয়ভিত্তিক তথ্য ও জ্ঞান সহভাগিতা করেন। এই শিক্ষামূলক ভূমিকা জনগণের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংক্রান্ত ধারণা বৃদ্ধি করে এবং স্থানীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করে। এভাবে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকেরা পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবর্তনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করবেন, যা একটি স্থায়িত্বশীল ও সবুজ ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে।
প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে সবুজ সংহতি
তথ্য ও শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সবুজ সংহতির সদস্যরা সক্রিয়ভাবে ক্যাম্পেইন ও প্রমাণভিত্তিক অ্যাডভোকেসি কর্মসূচি পরিচালনা করে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের সংবেদনশীল করা এবং কার্যকর পরিবেশ সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিতে প্রভাবিত করা। এ লক্ষ্যে সবুজ সংহতি সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করে, যেখানে সরকারি কর্মকর্তাসহ, উন্নয়নকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে গবেষণার ফলাফল, কমিউনিটির পর্যবেক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়, যা নীতিনির্ধারকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, সবুজ সংহতি স্মারকলিপি, পলিসি ব্রিফ ও গবেষণা প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসে জমা দেয়, যাতে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিবেশগত অগ্রাধিকারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হয়। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ তথ্য ও ঘটনা তুলে ধরা হয়, যা জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে। এই সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সবুজ সংহতি কর্তৃপক্ষের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে, যাতে তারা নতুন নীতিমালা প্রণয়ন কিংবা বিদ্যমান নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে। এই অ্যাডভোকেসি কার্যক্রমের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়ে যে, প্রকৃতি সংরক্ষণ শুধুমাত্র পরিবেশের বিষয় নয়, এটি জাতীয় কল্যাণের প্রশ্ন। এভাবেই সবুজ সংহতি একটি শক্তিশালী ও কৌশলগত প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে কাজ করে।
বিনোদনদাতা হিসেবে সবুজ সংহতি
প্রকৃতির মাঝে মানুষ খুঁজে পায় প্রশান্তি ও আনন্দ। পাখির কলরব, বন্য প্রাণীর বিচরণ, বন ও বনজ গাছগাছালির সবুজ দৃশ্য মানুষের মন ও মননে প্রশান্তির অনুভূতি এনে দেয়। তাই তো ছুটির দিনে মানুষ বন, পাহাড়, নদী ও সমুদ্রের পথে যায় প্রাকৃতিক পরিবেশে নিজেকে ফিরে পেতে। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু বিনোদনই দেয় না; মানুষকে সুস্থ করে এবং তাদের ভেতরে কৃতজ্ঞতাবোধ জাগিয়ে তুলে। সবুজ সংহতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশেই হলো এই সৌন্দর্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করা, যার মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশগত ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়। এই উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি নেতৃত্বাধীন ইকো-ট্যুরিজম, পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক কৃষি, লোকায়ত জ্ঞান ও প্রথার পুনরুজ্জীবন, যা প্রাকৃতিক সম্পদ পুনরুদ্ধার ও স্থায়িত্বশীল জীবনের জন্য অপরিহার্য। এই কার্যক্রম একদিকে যেমন স্থানীয় মানুষকে ক্ষমতায়ন করে, অন্যদিকে পরিবেশগত ভারসাম্যতা গড়ে তোলে। যদি এসব কার্যক্রম সফলভাবে বিস্তার ও পুনরাবৃত্তি করা যায়, তাহলে সবুজ সংহতি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এর মাধ্যমে সবুজ সংহতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ সবুজ পৃথিবী উপহার দিতে সক্ষম হবে, যেখানে তারা প্রকৃতিকে উপভোগ করবে, উদযাপন করবে এবং আনন্দের সঙ্গে বাস করবে।
উপসংহার
পরিবেশ সংকটের এই সময়ে, যখন চারদিকে হাহাকার, ধ্বংসযজ্ঞ, নদীগুলো যখন প্লাস্টিকের বোঝায় হাঁসফাঁস করে, তখন সবুজ সংহতি সবার জন্য একটি আশার আলো হয়ে দাঁড়ায়। এই নেটওয়ার্কটি জ্ঞান, সহমর্মিতা এবং সম্মিলিত শক্তির আলো জ্বালিয়ে সবাইকে পথ দেখায়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা সুরক্ষা, জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং খাদ্য সার্বভৌমত্ব আন্দোলন শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় মানুষের কাজ নয়, বরং আমরা সবাই যারা এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছি, শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি এবং সবুজ্ স্বপ্ন দেখছি, আমাদের সবারই অংশদারিত্ব ও দায়িত্ব রয়েছে এ সবুজ আন্দোলনে শামিল হওঢয়ার।
যেভাবে তথ্যকেন্দ্র, শিক্ষক এবং অক্লান্ত প্রবক্তা হিসেবে সবুজ সংহতি মানুষের সাথে প্রকৃতির গভীর বন্ধনকে পুনরুজ্জীবিত করছে, হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান ফিরিয়ে আনছে, স্থানীয় মানুষের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করছে এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচিকে শক্তিকে জাগিয়ে তুলছে, ঠিক সেভাবেই আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সবুজ সংহতিকে আরও শক্তিশালী ও বেগবান করতে পারি। তবে সবুজ সংহতির পক্ষে এই বিশাল দায়িত্ব একা একা পালন করা সম্ভব নয়। তাই্ আমাদের এই আহ্বান খুবই স্পষ্ট এবং শ্রবণ করার মতো। আসুন আমরা একসাথে দাঁড়াই, হাতের সাথে হাত, হৃদয়ের সাথে হৃদয় মিলিয়ে একটি সবুজ, মমতাময় এবং বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি। আসুন আমরা বায়ুর ক্রন্দন, মাটির গান এবং পৃথিবীর কান্না শোনার চেষ্টা করি সক্রিয়ভাবে। কেবল রক্ষক হিসেবে নয়, এই মাটির-পৃথিবীর নিরাময়কারী হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করি। কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানে শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকেই রক্ষা করার শামিল।
তাই আবারও সবাইকে আহ্বান জানাই এই আন্দোলনে নিজেকে শামিল করার চেষ্টা করুন নিরন্তরভাবে। একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য, একটি সবুজ পৃথিবীর জন্য, সকল প্রাণের জন্য এবং আমাদের আগমাী প্রজন্মের জন্য আসুন আমরা একটি জীবন্ত, ভালোবাসাময়, প্রেমময় ও যত্নশীল পৃথিবী গড়ে তুলি এখনই!