Wicking Bed সেচ সাশ্রয়ি ও পানি সংরক্ষণ করে চাষাবাদের একটি টেকসই কৃষি প্রযুক্তি
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সারা বিশে^র কৃষি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য আজ হুমকঅর মূখে। জলবায়ুর প্রভাবে বিশে^ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে খরা, অনাবৃষ্টি/অতিবৃষ্টি/অসময়ে বৃষ্টি, প্রচন্ড শীত/গরম, ফসলের রোগ-বালাইয়ের প্রর্দুভাব। খাদ্য উৎপাদনে সেচ সংকটাপন্ন হওয়ায় মানুষসহ সকল প্রাণের খাদ্য নিরাপত্তাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশে^র অনেক জমি পতিত রয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মিঠা পানির সংকট এবং বরেন্দ্র অঞ্চল ও সীমান্ত অঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। ভূ-গভৃস্থ পানির স্তর প্রতিবছর নিচে নেমে যাওয়ায় চাষের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করেও সেচের পানির সংস্থান হচ্ছে না। এমনকি সুপেয় পানিরও ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। খরা মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন খরাপ্রবণ দেশের কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ ও গবেষকগণ যেমন-আফ্রিকা, কেনিয়া, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশের খরা মোকাবেলায় কম সেচ ও কম সার ব্যবহার করে (পানি ও পানির অপচয় হ্রাসে) এবং সেচ কাজে ব্যবহৃত পানি সংরক্ষণ করে কোন ধরণের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে (প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর) সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের টেকসই কৃষি প্রযুক্তি Wicking Bed আবিষ্কার করে। এ পদ্ধতিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির উন্নয়ন নিশ্চিত করে চলেছেন। Wicking Bed ইতিমধ্যে বিভিন্ন খরাপ্রবণ ও শীত প্রবণ দেশে সেচ সাশ্রয়ি ও সার সাশ্রয়ি প্রযুক্তি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

বারসিক দাতা সংস্থা Diakonia এর আর্থিক সহায়তায় Resilience through Water Saving Technology for Farming প্রকল্পের মাধ্যমে (৪৫ দিনের স্বল্প মেয়াদী প্রকল্প) বারসিক’র নেতৃত্বে বাংলাদেশের ৩টি কর্মএলাকায় (নেত্রকোণা, রাজশাহী ও মানিকগঞ্জ) সেচ সাশ্রয়ি ও ব্যবহৃত পানি সংরক্ষণ করে চাষাবাদে টেকসই কৃষি প্রযুক্তি ডরপশরহম ইবফ ৬টি নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৬টি প্রচলিত বেড/সাধারণ সবজির বেড তৈরি করে দু’টি বেডের মধ্যে তুলনামুলক সেচ ও সার ব্যবহার এবং পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহারের সুবিধা/লাভজনকতা (খরা সংকট মোকাবেলায়) দেখা হচ্ছে। ৬টি নির্মিত ডরপশরহম ইবফ এর মধ্যে বারসিক নেত্রকোণা রির্সোস সেন্টারে ২টি, রাজশাহী (পবা ও তানোর) এবং কৃষকের তত্ত্বাবধানে ৩টি এবং মানিকগঞ্জে (হরিরামপুর) ১টি। অনুরূপ সংখ্যায় তিনটি এলাকায় ৬টি সাধারণ/প্রচলিত বেড তৈরি করে দুই ধরণের বেডে চাষাবাদের (সেচ, সার ও পানি সংরক্ষণ) তুলনা করে দেখা হচ্ছে।

Diakonia Bangladesh এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ও প্রেগ্রাম অফিসার এবং বারসিক’র নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালকসহ (গবেষণা বিভাগ) চারজনের একটি দল সম্প্রতি Wicking Bed প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনে বারসিক নেত্রকোণা রির্সোস সেন্টারে নির্মিত ২টি ডরপশরহম ইবফ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকারী দল Wicking Bed-এ চাষকৃত ৭ ধরণের সবজি প্লট (মটর, ফরাশ, লেটুস, ধনিয়া, শালগম, শসা, বাটিশাক) এবং প্রচলিত ২টি বেডে চাষকৃত ৮ ধরণের সবজি প্লট (লেটুস, গাজর, মরিচ, লারশাক, বেগুন, টমাটো, বথুয়াশাক, কালোকচু) পরিদর্শন করেন। সফরকালে তারা Wicking Bedএর সেচ প্রযুক্তি, পানি সংরক্ষণাগার (পাটির ট্যাংক) ও সংরক্ষিত পানির পুনঃব্যবহার এবং সেচ সাশ্রয় প্রযুক্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পাশাপাশি তারা প্রচলিত সবজি বেডে ব্যবহৃত সেচ ও সারের অপচয়, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনাগত অস্থায়িত্বতা সম্পর্কেও জানতে সক্ষম হন। সেচ সাশ্রয়ি ও পানি সংরক্ষণ করে চাষাবাদের টেকসই কৃষি প্রযুক্তি Wicking Bed নির্মাণ কৌশল এবং এর কার্যকারিতা ও যথার্থতা সম্পর্কে পরিদর্শনকারী দল ও কৃষক-কৃষাণীদেরকে বর্ণনা করেন সহযোগি সমন্বয়কারী শংকর ম্রং।

সরেজমিনে Wicking Bed কার্যকক্রম পরিদর্শন শেষে পরিদর্শনকারী দল এলাকার কৃষক-কৃষাণী সংগঠনের প্রতিনিধি ও বারসিক নেত্রকোণা অঞ্চলের কর্মীদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। মতবিনিময় সভায় তারা এলাকার কৃষক-কৃষাণী ও বারসিক নেত্রকোণা অঞ্চলের কর্মীদের সাথে পরিচিত হন। সফরকারীগণ Wicking Bed প্রযুক্তি সম্পর্কে উপস্থিত কৃষক-কৃষাণী ও কর্মীদের মতামত জানতে চান এবং বারসিক নেত্রকোণা অঞ্চলের (হাওর, সমতল ও সীমান্ত এলাকা) বাস্তবায়িত কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। সফরকারী দাতা সংস্থার প্রতিনিধিগণ স্বল্প সময়ে Wicking Bed কার্যক্রমের অগ্রগতি ও সফতার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
Wicking Bed নির্মাণ কৌশল
প্রথমে ৩২ ফুট দৈর্ঘ্য/ ৩ ফুট প্রস্থ এবং ২.৫ ফুট গভীরতা সাইজের একটি গর্ত তৈরি করে চারপাশ ও নিচের তলাটি সমান করে নিতে হবে। গর্তের চারদিক নিচ থেকে উপরে ৩ ফুট পর্যন্ত ইটের গাথঁনি দিতে হবে এবং সেচের পানি যাতে নিচে চুইয়ে যেতে না পারে সেজন্য ইটের সুরকী/খোয়া দিয়ে ৩/৪ ইঞ্চি পুরু করে ঢালাই করতে হবে এবং সিমেন্ট দিয়ে লেপন করতে হবে। এরপর ইটের গাথুঁনী দেয়া চারদিকের দেয়াল প্লাস্টার করে দিতে হবে। বেডের ৩/৪ ফুট ব্যবধানে একটি ৪ ফুট/৪ ফুট আকারের ৪ ফুট গভীরতার একটি স্কয়ার গর্ত করে বেডের অনুরূপ পদ্ধতিতে নিচে ঢালাই ও চারপাশ ইট দিয়ে গেঁথে প্লাস্টর করে পানির ট্যাংক নির্মাণ করতে হবে। ট্যাংকের তলাটি অবশ্যই বেডের তলটির চেয়ে কমপক্ষে ১ ফুট নিচু হতে হবে, যাতে Wicking Bed ’র তলায় সেচের জন্য ব্যবহৃত সার মিশ্রিত পানি নিচে বসানো পানির ফিল্টার দিয়ে ট্যাংকে গিয়ে সংরক্ষিত হতে পারে।

বেড ও ট্যাংক নিমার্ণ হয়ে গেলে নিয়ম অনুযায়ী পানি দিয়ে ভিজিয়ে ইট ও কংক্রিট অংশটুকু কিউরিং করে নিতে হবে। কিউরিং শেষে বেডের নিচে ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে নূড়ি পাথর ভি (V) আকৃতিতে বিছিয়ে নিয়ে বেডের মাঝ অংশ থেকে (৩২ ফুট হলে ১৬ ফুট হবে) ১.৫ ইঞ্চি সাইজের ১৬ ফুট লম্বা পানির ফিল্টার বেডের মাঝ বরাবর টেনে (V) পানির রিজার্ভ ট্যাংকের সাথে যুক্ত পানির পাইপের সাথে যুক্ত করে দিতে হবে। এরপর ২ ইঞ্চি সাইজের ৪ ফুট লম্বা পাইপের এক মাথায় এলবো লাগিয়ে এলবো অংশটি নিচে রেখে বেডের এক কোনে খাড়াভাবে সোজা করে বসিয়ে পুরো বেডটি নূড়ি পাথর ফেলে পানির ফিল্টারটি সম্পূর্ণ ঢেকে দিতে হবে ৩/৪ ইঞ্চি পুরু করে। এর পর ৬/৮ ইঞ্চি পূরু করে কাঠের গুড়ো/স-ডাস্ট বিছিয়ে সমান করে বসাতে হবে। এর উপর পূর্বে থেকে তৈরী করে রাখা কম্পোস্ট ও মাটির মিশ্রণটি Wicking Bed ’র উপর পর্যন্ত কানায় কানায় ভরতে হবে। এরপর ১ ইঞ্চি আকারের পানির পাইপ পানির পাম্প থেকে টেনে বেডের শেষ মাথা পর্যন্ত (বেডের সাথে আটকে দিতে হবে) বেডের দুই মাথায় দু’টি থ্রি এলবো দিয়ে লাইন বের করে চাবি দিয়ে মূখ আটকে দিতে হবে যাতে প্রয়োজনমত বেডে সেচ দেয়া যায়। এরপর উপরের মাটি সমান করে বসিয়ে প্রয়োজনে সামান্য সেচ দিয়ে বেডের মাটিকে ফসলের বীজ রোপনের উপযোগি করতে হবে। এর পর পানির ট্যাংকে পাম্পের আকার অনুযায়ী পাইপ স্থাপন করে পাম্প মেশিনটি স্থাপন করা। এভাবেই নির্মাণ হবে একটি সেচ সাশ্রয়ি, পানি সংরক্ষণ করে চাষাবাদে টেকসই কৃষির Wicking Bed প্রযুক্তি। যা’ নির্মাণে একবারই খরচ হবে কিন্তু টেকসই হবে প্রায় অর্ধশত বছরেরও বেশি সময়।
সেচ ও সার সাশ্রয়ি এবং সেচে ব্যবহৃত পানি সংরক্ষণ করে পুনরায় ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদনে Wicking Bed প্রযুক্তিটি টেকসই কৃষি প্রযুক্তি হলেও সাধারণ কৃষকদের জন্য এটি এককালীন সময়ের জন্য ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে কৃষকরা ইচ্ছা থাকলেও ডরপশরহম ইবফ নির্মাণ করে প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারবেন না। তাই নেত্রকোণা রির্সোস সেন্টারে Wicking Bed নির্মাণের অনুরূপ পদ্ধতিতে স্থানীয় সম্পদ ও কৃষকদের নাগালে রয়েছে এমন উপকরণ দিয়ে স্বল্প খরচে একটি বেড নির্মাণ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ইট, বালু, সিমেন্টের পরিবর্তে বাঁশ, মোটা পলিথিন শীট এবং পাথরের পরিবর্তে ইটের খোয়া (জামা) এবং পানির ট্যাংকের স্থলে প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পাকা Wicking Bed এর খরচের একতৃতীয়াংশ খরচে টেকসই বেড নির্মাণ করা সম্ভব। যা’ প্রচলিত সবজির বেডের চেয়ে অনেক সেচ সাশ্রয়ি এবং ব্যবহৃত সার মিশ্রিত পানি সংরক্ষণ করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এই প্রযুক্তিটি এককালীন ব্যয়বহুল হলেও দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই।