কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চায় মিলছে সম্মান ও আর্থিক স্বচ্ছলতা
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
গল্পটি একজন অদম্য নারীর। গল্পটি এগিয়ে যাওয়ার। এই গল্পটি অনুপ্রেরণার। গল্পটি রাজশাহীর পবা উপজেলার কারিগর পাড়া গ্রামের বিলকিস বেগমের (৫৫)। যিনি তার অদম্য ইচ্ছা শক্তি দিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা। একজন প্রবীণ নারী হয়েও তাঁর বাড়িতে একে একে গড়ে তুলেছেন ছোট বড় ৪টি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন খামার এবং নিজের এক টুকরো জমিতে সারাবছর বিষমুক্ত সবজি চাষ করে নিজের পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কিছু বিক্রয়ের ব্যবস্থাও হয়।
কষ্টের সময়গুলো
২০১৫ সালে ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পরে ছেলে ভিন্ন হয়ে গেলেও স্বামী মোঃ রশিদ খা ঁ(৬০) কৃষি শ্রমিক হিসেবে যা আয় করত তা দিয়ে মোটামুটি সংসার চলে যেত। সে বছরই হঠাৎ একদিন স্বামী রশিদ খাঁ পুকুর ধারে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটতে গিয়ে পরে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন। পরিবারে একজন মাত্র আয়ের ব্যাক্তিটি চলতে ফিরতে পারেন না। শুরু সংসারে অভাব অনটন। জমানো টাকা তেমন কিছুই নেই, যা ছিলো স্বামীর পায়ের চিকিৎসা করতেই শেষ। এর মধ্যে একদিন তাঁর স্বামী পেটে ব্যথা অনুভব করলেন হাসপাতালে চিকিসৎসা করিয়ে জানতে পারলেন লিভারে জটিল অসুখ ধরা পড়েছে। দিশেহারা হয়ে স্বামীর চিকিসৎসা করানোর তাগিদে পাশের গ্রামের একটি বাসা বাড়িতে কাজ নেন। কাজ করে যে টাকা পান তা দিয়ে স্বামীর ঔষধ কেনার পর দিনে এক বা দু বেলা অনাহারেও থেকেছেন কোন কোন দিন। বাসা বাড়িতে কাজের পাশাপাশি তিনি চিন্তা করতে থাকেন বাড়তি আয়ের রাস্তা। এর মধ্য তাঁর স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে একে একে ১৭টি সংস্থার কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঋণ হয়ে যায়। ২ বিঘা জমিও বন্ধক রাখতে হয়। কিস্তির চাপে আরো দিশেহারা হয়ে পড়েন বিলকিস বেগম। তবে তাঁর স্বামী মোটামুটি সুস্থ হলেও কোন কাজ করতে পারেন না।

ঘুরে দাঁড়ানো গল্প
বাসা বাড়িতে কাজ করার পর অবসর সময়ে কিছুদিন কাঁথা সেলাই করেছেন বিলকিস বেগম। এরপর ২০১৬ সালে একটি বেসরকারী সংস্থা ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে আসে। কিছু করার ইচ্ছে থেকে সেবার সেখানে বিলকিস বেগম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর চিন্তা করেন এখান থেকে কিছু করার। বাসাবাড়িতে কাজের জমানো ২০০ টাকা দিয়ে একটি মাটির চারি (মাটির পাত্র) কেনেন আর ওই সংস্থা থেকে পান ৫০০টি কেঁচো। প্রথম চালানে পান ৫ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার। তা তিনি নিজের সবজি বাগানে প্রয়োগ করেন। ২য় চালানে পান ১০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার। আগের সবজি বাগানে যে সারটুকু ব্যবহার করেছিলেন সেখানে ভালো ফলাফল দেখে প্রতিবেশি এক নারী ২য় চালানের ১০ কেজি সার ১৫০ টাকা দিয়ে কিনে নেন। ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদনের সাথে সাথে কেঁচোও বাড়তে থাকে। তখন তিনি অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে ৫টি মাটির চাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করতে থাকেন। ঠিক এসময়ে পরিচিত হন বাংলাদেশ রির্সোস সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)’র। বারসিক প্রথমে একটি টিনের বড় সেড নির্মাণ করে দিয়ে ৫০টি মাটির চাড়িতে ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদনের ব্যবস্থা করে দেয়। সেখান থেকে এক চালানে ২০ দিন পর পর ৫ মণ ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন হয়। এরপর থেকে বিলকিস বেগমকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতি মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় হয় শুধু ভার্মি কম্পোস্ট খামার থেকে। আস্তে আস্তে ১৫টি সংস্থার ৯ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করেছেন। পাশাপাশি বন্ধক রাখা ২ বিঘা জমি ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেই চাষাবাদ করছেন এখন। চাষাবাদে শুধু ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করেন। তা দেখে অন্য কৃষকরা আগ্রহী হয়ে তার কাছ থেকে ভার্মি কম্পোষ্ট সার কিনে নিয়ে যান। তিনি সফলতার পাশাপাশি অন্যকেও সহযোগিতা করেন। তিনি প্রতিবেশি ৩৫ জন নারীকে ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদন করা কৌশল শিখিয়েছেন। যদি বড় কোন অর্ডার আসে তাহলে সবার কাছ থেকে ভার্মি কম্পোষ্ট সার নিয়ে সেই সারগুলো এক জায়গায় করে চাহিদা মতো পাঠিয়ে দেন। এ বিষয়ে প্রতিবেশি নারী মোসাঃ রেনুকা বেগম (৪৫) বলেন, “আমি ৫টি চারি ও বিলকিস বেগমের নিকট থেকে ১ হাজার কেঁচো নিয়ে কাজ শুরু করি। এখন আমার ৫০টি চাড়িতে সার উৎপাদন হয়। বড় অর্ডার হলে আমরা সবার সার এক সাথে করে সেখানে বিক্রয় করে নিজেদের মধ্য টাকা ভাগ করে নিই।’

এতো কাজের পাশাপাশি বিলকিস বেগমের বাড়ির পাশের ৪ শতাংশ পতিত জমিতে সারাবছর মৌসুমী শাকসবজি চাষ করেন। সেখানে ভার্র্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন। রোগবালাই দমনে প্রয়োগ করেন নিম পাতার নির্যাস। গো-চনা, ছাই, মেহগনির ফলের নির্যাস ইত্যাদি। এখান থেকে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও কিছুটা সবজি বিক্রয় হয়। তার নিকট থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন অনেক কৃষক নিজেদের জমিতে ভার্মি কম্পোস্ট দিয়ে ফসল উৎপাদন করেন। পরিবেশবান্ধব কৃষি এলাকায় ছড়িয়ে দিতেও বিলকিস বেগমের রয়েছে অসাম্য অবদান।

মিলছে স্বীকৃতিও
সংগ্রামী বিলকিস বেগমের এই অদস্য শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার গল্প ছাপা হয় দেশের প্রথম সারীর জাতীয় পত্রিকায়। তখন তার সার বিক্রয় আরো বেড়ে যায়। ২০২৪ সালে তিনি পান জেলার শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জয়িতা পুরষ্কার। সেখান থেকে ২০২৫ সালে পান বিভাগীয় অদম্য নারী পুরষ্কার। যা তাকে অনুপ্রেরণা জোগায় আরো ভালোভাবে কাজটি করতে। এই সম্মান আরো হাজারো নারীর অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছেন বিলকিস বেগম। তিনি বলেন, “ইচ্ছেশক্তি দিয়ে সব কিছু জয় করা সম্ভব। আমি চাই আমার মতো অনেক প্রান্তিক নারীকে সহযোগিতা করা হোক। একটু সহযোগিতা পেলে তারা যে এগিয়ে যাবে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমি কাজের মাধ্যমে তাঁদের সহযোগিতা করে এগিয়ে নিয়ে আসতে চাই।’