নাজিরপুরের ভাসমান সবজি চাষঃ বিশ্ব কৃষি ঐতিহ্যের সম্ভাবনা

নাজিরপুরের ভাসমান সবজি চাষঃ বিশ্ব কৃষি ঐতিহ্যের সম্ভাবনা

:: দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূল অঞ্চল
devdas-pic-4 (2)কৃষিজমি যেখানে নিম্নাঞ্চল সেখানে বছরজুড়েই জলাবদ্ধতা। সেই সাথে বছরজুড়ে কচুরিপানায় ভর্তি। অনিবার্য কারণে কৃষি এখানে বিপন্ন। বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে কৃষকের লড়াইটা আজন্মকাল ধরে। আশার কথা, বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝেও কৃষকরা তাঁদের লোকায়ত জ্ঞান ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কৃষিকে বাঁচানো কিংবা কৃষির সম্প্রসারণে স্থানীয় মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী কিংবা পরিবেশের সাথে কৃষি খাপ খাওয়ানোর মত কৌশল উদ্ভাবন করে টিকে থাকা অঞ্চলভেদে আলাদা। উপকূলীয় পিরোজপুরের নাজিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকরা তাদের জলাবদ্ধ কৃষিজমি নিবিড় ব্যবহার করে উদ্ভাবন করেছেন ভাসমান কৃষিজমির রাজ্য। নিজস্ব ধ্যান ধারণায় গড়ে তোলা ভাসমান আবাদ এখন একটি দৃষ্টান্ত সবার কাছে। নাজিপুর উপজেলার অন্তত ২০টি গ্রামের হাজার হাজার হেক্টর নিম্নাঞ্চল জলাবদ্ধ কৃষিজমি পতিত থাকার কথা। কিন্তু সেখানে ভাসমান আবাদের সমারোহ। ফলে এখানে বিপন্ন কৃষকের মিলেছে অর্থনৈতিক মুক্তি। নাজিরপুরের বিলাঞ্চলে ভাসমান এ কৃষি বিপ্লব এখন বিশ্ব কৃষির ঐতিহ্যের অংশ ।

উপজেলার নিম্নাঞ্চল দেউলবাড়ি দোবড়া, মালিখালী ও দীর্ঘা ইউনিয়নের মুগারঝোর, কলারদোয়ানিয়া, দীর্ঘা, বৈঠাকাঠা, খলনি, মেদা, সাচিয়া, পাকুরিয়া, গাওখালী, পদ্মডুবি, বিল ডুমুরিয়াসহ অনেক গ্রামের পতিত জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে শাকসবজি ও তরকারির চারা উৎপাদন ও বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। স¤পূর্ণ পানির উপর ভাসমানভাবে চাষাবাদ হয় বলে স্থানীয়ভাবে এ চাষাবাদ প্রক্রিয়াকে ভাসমান পদ্ধতির চাষাবাদ বলা হয়ে থাকে। এলাকাবাসী ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিল এলাকা হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় উল্লেখিত তিনটি ইউনিয়নের বেশিরভাগ জমি সারাবছর জলমগ্ন থাকে। জলাবদ্ধ এসব জমিতে স্বাভাবিকভাবে কোন ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। বছরের পর বছর পতিত এ জমিতে কচুরিপানা, দুলালীবন, শ্যাওলা ও ফেনা ঘাসে ভরা থাকে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় অর্ধশত বছর পূর্বে স্থানীয় কৃষকেরা সম্মিলিত উদ্যোগে জমির পানিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া কচুরিপানা, শ্যাওলা, দুলালীবন পচিয়ে সারি-সারি কান্দি (আইল) তৈরি করে তার উপর ফসল চাষের চেষ্টা করে সফল হন। গোটা বিলাঞ্চলের শত শত হেক্টর পতিত জমি এখন এ প্রক্রিয়ায় এসেছে চাষাবাদের আওতায়। প্রতিবছর নতুন করে এ পদ্ধতির চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষ, বাড়ছে আবাদী জমির পরিমাণ। উপজেলার বিলাঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার পরিবার আজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আছে ভাসমান পদ্ধতির আবাদের সাথে। এক সময়ের দুঃখ কষ্টের দিন ঘুরে আজ কৃষকের মুখেও ফুটেছে আনন্দের হাসি। চলতি মৌসুমে উল্লেখিত বিল এলাকায় প্রায় একশত হেক্টর জমিতে বীজতলায় চারা উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছে আর ২ হাজার হেক্টর জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে কান্দি (আইল) তৈরি করে প্রস্তুতি চলছে শাকসবজি ও তরকারী আবাদের।

ভাসমান পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের জন্য যে প্রক্রিয়ায় পানির ওপরে কান্দি তৈরি করা হয় একই প্রক্রিয়ায় অন্য পতিত জমিতেও চারা রোপণের জন্য তৈরি করা হয় ভাসমান কান্দি। বিক্রির জন্য জমি থেকে চারা তুলে নিয়ে সেই জমিতে এবং চাষাবাদের জন্য প্রস্তুতকৃত জমিতে একই পদ্ধতিতে রোপণ করা হয় আলু, পটল, কুমড়া, সীম, পেঁপে, করল্লা, গাজর, কফি, টমেটো, লাউ, শালগমসহ হরেক রকমের বাছাই করা শাকসবজি ও তরকারির চারা। কান্দি তৈরিতে ব্যবহৃত কচুরিপানা, দুলালী ঘাস, ফেনা মাটি পচে তৈরি হওয়া জৈব সার আর নীচ থেকে প্রাকৃতিকভাবেই পর্যাপ্ত পানি পাওয়ায় কোন প্রকার রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই এ জমিতে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠে শাক সবজির চারা। প্রকৃতির দান আর কায়িকশ্রমে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কৃষকের ক্ষেত পরিচর্যায় প্রতিটি ভাসমান ক্ষেতে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয় বিভিন্ন প্রজাতির শাকসবজি ও তরকারি। ভাসমান পদ্ধতিতে উৎপাদিত শাকসবজি ও তরকারি স্বাদে যেমন হয় সুস্বাদু তেমনি আকারেও হয় অনেক বড়। ফলে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্যও থাকে ভালো। উপজেলার মালিখালী, দীর্ঘা ও দেউলবাড়ি দোবড়া ও কলারদোয়ানিয়ার ভাসমান পদ্ধতিতে উৎপাদিত শাকসবজি ও তরিতরকারী ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে স্থানীয় বৈঠাকাঠা ও মনোহরপুর বাজারে গড়ে ওঠেছে আলদাভাবে পাইকারী তরকারির বাজার। এ পাইকারী বাজার থেকে শাকসবজি, তরকারির স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়েও নৌপথে চালান করা হয় ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশের পাইকারী তরকারি বাজারে। মনোহরপুর বাজারের পাইকারী তরকারি বিক্রেতা জালাল ফকির জানান, প্রতি মৌসুমে এ অঞ্চলে গড়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার শাক সবজি ও তরকাররি বেচা কেনা হয়। মুগারঝোর গ্রামের সবজি চাষী জামাল জানান, চলতি মৌসুমে তার ৫ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের শাকসবজি ও তরকারির আবাদ করা হয়েছে। যা থেকে সকল খরচ বাদে কমপক্ষে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা মুনাফা করা সম্ভব হবে। একই ধরনের আশাবাদ খলনি গ্রামের আরজ আলী, সাচিয়ার ভুপেন মন্ডল ও বিল ডুমরিয়ার আলতাফ হাওলাদারের।

devdas-pic-1 (2)পতিত জমিতে স্থানীয় কৃষকদের উদ্ভাবিত ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ বাংলাদেশে কেবলমাত্র নাজিরপুরেই আছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছে এ অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার কৃষক পরিবার, পূর্বে যাদের দিন কাটতো অর্ধাহারে-অনাহারে, ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতিটি এলাকায় জনপ্রিয় হওয়ায় অনেক কৃষক পরিবার এ চাষ পদ্ধতির প্রধান উপকরণ কচুরিপানা বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে স্থানীয় কৃষকদের কাছে বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছেন। ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে আগ্রহ দেখিয়ে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন বিলাঞ্চলের কৃষকেরা পরামর্শ নিতে ও সরাসরি এ চাষ প্রক্রিয়া দেখতে আসছেন নাজিরপুরের বিলাঞ্চলে। ভাসমান পদ্ধতির চাষাবাদ সংশ্লিষ্টরা ও এলাকার বিশিষ্টজনদের অভিমত, ভাসমান চাষাবাদ একটি পরীক্ষিত লাভজনক চাষের পদ্ধতি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ভাসমান চাষ পদ্ধতির প্রসার ঘটাতে পারলে শুধু নাজিরপুরের নয় বরং গোটা বাংলাদেশের উপকূল এবং নিম্নাঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে খুলে দিতে পারে অপার সম্ভাবনার দ্বার। নাজিরপুর উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা কৃষিবিদ স্বপন কুমার মন্ডল জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিজমি পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষিখাতে যে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে তা কেবলমাত্র ভাসমান চাষ পদ্ধতি দিয়েই মোকাবেলা করা সম্ভব।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এএফও) কর্তৃক ‘কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বিলাঞ্চলের ভাসমান পদ্ধতির সবজি চাষ। এরই মধ্যে এ পদ্ধতিতে সবজি আবাদকে সম্ভাবনাময় গেন্ডাবালি ইমপোর্টেন্ট এগ্রিকালচারাল হেরিটেজ সিস্টেম (জিআইএএইচএস) সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সংস্থাটি। এবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি চূড়ান্ত স্বীকৃতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে; যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষি আবাদকে ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে এফএও। বাংলাদেশের ছয়টি কৃষি পদ্ধতি সম্ভাবনাময় জিআইএএইচএস সাইট হিসেবে সংস্থাটির স্বীকৃতি পেয়েছে। এর মধ্যে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি আবাদকে চূড়ান্ত স্বীকৃতির বিষয়ে চলতি বছর ২৮ জানুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে এফএও প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়। সে আলোচনায় চূড়ান্ত স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে এফএও প্রতিনিধিরা। তাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্টিয়ারিং কমিটি আবেদনের অনুমোদন দিয়েছে। কৃষিমন্ত্রীও সে আবেদনে অনুমোদন দিয়েছেন। আবেদনটি এখন এফএও কার্যালয়ে নিয়ম মেনে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রযুক্তিটি কৃষকদের উদ্ভাবনীশক্তির বহিঃপ্রকাশ। এটি বর্ষাকালে সবজির চাহিদা মেটাতে বড় ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব ঐতিহ্য স্বীকৃতি পেলে আবাদকে আরো গতিশীল করা সম্ভব হবে। আর এ ধরনের আবাদকে টিকিয়ে রাখতে বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেয়া দরকার। এ বিষয়ে নাজিরপুরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ননী গোপাল মজুমদার বলেন, “ভাসমান সবজি আবাদ দেশের একটি মডেল। নাজিরপুর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটা এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশের প্রথম কৃষি ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এফএওর নীতিমালা এবং নিয়ম মেনেই এজন্য আবেদন করা হয়েছে। চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী।”

happy wheels 2

Comments