কারোনা বাস্তবতা ও আমাদের স্বপ্ন

নিরালা পুঞ্জি শ্রীমঙ্গল থেকে সিলভানুস লামিন:
এক
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব একটা স্বপ্ন থাকে। মূলত স্বপ্নকে লালন করেই মানুষ তাদের প্রতিদিনের পথচলা শুরু করে। কেউ স্বপ্ন দেখেন নিজের ক্যারিয়ার গঠন করার, কেউ স্বপ্ন দেখেন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এক একজন সফল মানুষ হওয়ার আবার কেউবা স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানকে ঘিরে। সন্তানদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলে তাদেরকে ডাক্তার, বিজ্ঞানী, প্রকৌশল, সফল চাকুরিজীবী এবং ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলবেন। তাই প্রত্যেক মানুষই তাদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য নানানভাবে বিনিয়োগ করেন। কেউ সন্তানদের শিক্ষার পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করেন, কেউবা নিজেকে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শ্রম ও অর্থ দু’টিই বিনিয়োগ করেন এবং কেউ কেউ গভীর সাধনা ও পড়াশোনার মাধ্যমে তাদের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চান। কিন্তু করোনা বাস্তবতা সবকিছুকেই থেমে দিয়েছে। এই ভাইরাস আসার পর থেকেই মানুষ আতংকে দিনাতিপাত করছেন। কোন ওষুধ আবিষ্কৃত না হওয়ায় মানুষকে বেশি চিন্তিত করে তুলেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বলতে গেলে অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপসনালয়সহ নানান প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। বলতে গেলে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রা এরকমে থেকেই গেছে এই ভাইরাস আসার পর থেকে। সবার আলোচনায় এখন কোভিড-১৯ মূল বিষয়। বেশির ভাগ মানুষই এখন ঘরে অবস্থান করছেন। যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য সেই তারা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েছেন এক ধরনের আতঙ্ক ও ভয়কে সঙ্গী করে! অন্যদিকে এই করোনা ভাইরাস আসার পর থেকেই সারাবিশে^র মানুষ নতুন নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছে। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন প্রতিটি মানুষেরই মুখে মুখে। শিক্ষিত, নিরক্ষর কিংবা অর্ধশিক্ষিত সবার কথাবার্তায় এ শব্দগুলো প্রবেশ করেছে।

দুই
স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য মানুষের ভেতরের যে মনোবাসনা বা আকাঙ্খা এক করোনা ভাইরাসের আগমনে গভীর হোঁচট খেয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রম বলতে গেলে থেমে গেছে। শিক্ষার্থীরা যারা স্বপ্ন দেখে একদিন তারা ডাক্তার, উকিল, প্রকৌশল, সফল ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী এবং দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার হবে তারা বিগত চার মাস ধরে বাসায় অবস্থান করছে। অনেকে এসময় অনলাইনভিত্তিক ক্লাস করেছে ঠিকই কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেতে না পারায় তাদের এ শিক্ষালাভ যেন অসম্পূর্ণ থেকেছে। অন্যদিকে যাদের বাড়িতে টিভি নেই কিংবা যাদের ইন্টারনেট সুবিধা নেই কিংবা যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করছে তারা বলতে গেলে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্নই থেকেছে বিগত এ চার মাসে। আমার সন্তানদের কথায় ধরা যাক। তারা বিগত চার মাসে ঘরেই থেকেছে। অনলাইন বা টিভিতে যে ক্লাশ হয় সেটা অনুসরণ করতে পারছে না। কারণ আমাদের এলাকায় বিদ্যুত ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন নয়। এছাড়া এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কই যেখানে ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে ইন্টারনেট সুবিধা প্রত্যাশা করা যায় না। আমার সন্তানেরা অবশ্যই বই ও খাতা নিয়ে বসে প্রতিদিন কিন্তু তাদের মনোযোগ নেই। তাই তাদেরকে ঘিরে আমার যে স্বপ্ন লালন করেছি কিছুটা হলেও ঢাক্কা খেয়েছে। আমি নিজেও জানিনা তারা কবে থেকে ক্লাশরুমে যাবে, তাদের স্বাভাবিক শিক্ষালাভ প্রক্রিয়াটা চালিয়ে যেতে পারবে। আমার মতো বাংলাদেশে অসংখ্য অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আজ সন্দিহান এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই হয়তো সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত থাকতে হবে আমাদেরকে। সন্তানদেরকে ঘিরে আমরা যে স্বপ্নটা লালন করে আসছি এবং তাদের পেছনে আমরা যে বিনিয়োগটা (শ্রম, অর্থ, উপদেশ, ভালোবাসা) করে আসছি সেটি কী হবে ভাবতেই কেমন জানি ভয় করছে!

তিন
আমরা যা দিনরাত পরিশ্রম করি, চাকুরি এবং ক্ষুদ্র, মাঝারি বড় ব্যবসা করি আমাদের স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য করোনা ভাইরাসের কারণে আজ অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। যারা দিন মজুর করেন, কৃষি কাজ করেন, কিংবা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। প্রায় দু’মাসে সাধারণ ছুটি ঘোষণার সময়েও অনেক মানুষ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছেন। যে এলাকায় লকডাউন হয়েছে সে এলাকার মানুষও জানেন দুই কিংবা তিন সপ্তাহ সবকিছু বন্ধ থাকলে কেমন জানি তারা অসহায়বোধ করেছেন। বিশে^র বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন খোলার জন্য মানুষ রাস্তায় নেমেছিলো। কারণ সবাই বাঁচতে চায়, সবাই তাদের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। এ স্বপ্ন পূরণ করার জন্য তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হয়। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল করে রাখতে হয় কিন্তু করোনা বাস্তবতা তাদেরকে সেই সুযোগ দিচ্ছে না। বিভিন্ন দেশের সরকারও মানুষের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে লকডাউন, কারফিউ বা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে যাতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে। তবে করোনা এখনও মহামারী আকারই রয়েছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইউরোপে এই ভাইরাস দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ করতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ভারতে এখনও এই ভাইরাস অনেক মানুষকে আক্রান্ত করেছে। আমাদের বাংলাদেশেও এই ভাইরাস প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ থেকে ৩০০০ মানুষকে আক্রান্ত করছে। তাহলে আমরা কী আমাদের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো না? দীর্ঘদিন থেকে লালন করে আসা স্বপ্ন কী অধরাই থেকে যাবে? আমার বিশ^াস, পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের অসাধ্য কাজ মানুষই সাধ্য করেছে, কঠিনকে সহজ করেছে। তাই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সারাবিশে^র মানুষের যে লড়াই এখন চলমান রয়েছে সেই লড়াইয়ে মানুষই যে জয়ী হবে তাতে আমার বিন্দুটুকু সন্দেহ নেই। তবে এটা ঠিক এই করোনা ভাইরাস মানুষকে চরম ভুগিয়েছে। এই ভাইরাসকে নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী বা স্বাস্ব্য বিশেষজ্ঞ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের (অক্সফোর্ড) সংবাদ আমরা টিভিতে বা পত্রিকান্তরে জেনেছি। আশা করছি, শিগগিরই এই ভ্যাকসিন কার্যকর হবে এবং নিরাপদে মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। মানুষকে যে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে! কারও কী সাধ্য আছে সেই স্বপ্ন পূরণকে বাধাগ্রস্ত করতে?

happy wheels 2