মাতৃভাষা: আমাদের আত্মপরিচিতি ও সংস্কৃতির পরিচায়ক

সিলভানুস লামিন

এক
যেকোন দেশের মানুষের প্রথম ভাষা, মাতৃভাষা, সহজাত ভাষা বা নৃতাত্ত্বিক ভাষা সে মানুষের পরিচিতি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থানের ভিত্তি। বলা হয়, মাতৃভাষায় মানুষ যেভাবে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে অন্য আরও কোন ভাষায় তা পারে না। একজন মানুষের জন্য তার মাতৃভাষাটি তাই তার জন্য একটি আর্শীবাদ, একটি গৌরব এবং একটি সম্পদস্বরূপ। মাতৃভাষায় সে সহজে শিখতে পারে, পড়তে পারে এবং প্রকাশ করতে পারে। মানুষের সহজাত ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যমই হচ্ছে তার মাতৃভাষা। অন্যদিকে মাতৃভাষা হচ্ছে একটি জাতির আত্মপরিচয়ের সূচক; মাতৃভাষা জাতির অস্তিত্বের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। মাতৃভাষায় আমরা মনের ভেতরের অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবটিও প্রকাশ করতে পারি, যোগাযোগ করতে পারি। আমাদের চিন্তা, ধ্যান, আশা-আকাঙ্খা এবং স্বপ্নের ভালো বহিঃপ্রকাশ হয় মাতৃভাষায়; বিদেশি ভাষায় নয়। মাতৃভাষার বিলুপ্তি মানে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করার শামিল।

দুই
আমাদের কাছে মাতৃভাষা কতটা যে গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে নতুন করে আর কিছুর বলার নেই। আমরা সবাই জানি, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং বাংলার মর্যাদা ও সম্মানকে সমুন্নত করে রাখার জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার জীবন বির্সজন দিয়ে এই ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা উচ্চশিরে বিশ্বের দরবারে মায়ের ভাষা বাংলাকে সম্মান ও মর্যাদার সাথে তুলে ধরতে পেরেছি। বিশ্বের আর কোন দেশ মাতৃভাষার জন্য জীবন বির্সজন দেওয়ার কোন নজির নেই। ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজ প্রতিবছর এই দিনটিতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬০০ কোটিরও অধিক মানুষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন করে। এটি আমাদের সবার জন্য বিশাল একটি অর্জন; একটি গৌরবের বিষয়!

তিন
ভাষা হচ্ছে ভাবের বাহন এবং তা মায়ের ভাষাতেই স্বাচ্ছন্দ্যরূপে পরিস্ফুট হয়। বহুভাষাবিদ, গবেষক, প-িত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন, “বাহন উপযুক্ত না হলে কেউ তার উপযুক্ত স্থানে পৌঁছুতে পারে না।” এখানে বাহন মূলত মাধ্যম বা মাতৃভাষাকে বুঝানো হয়েছে। মাতৃভাষাটি একজন মানুষ প্রত্যক্ষ বা সচেতন এবং পরোক্ষ বা অবচেতন পদ্ধতিতে শিখে নেয়। প্রত্যক্ষ পদ্ধতির মাধ্যমে মাতৃভাষা একজন মানুষকে জ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করতে এবং জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে, যা তাকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে। অন্যদিকে একজন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক এবং শারীরিক শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা একটি অবিচ্ছেদ্য মাধ্যম বা বাহন হিসেবে কাজ করে। মাতৃভাষা হচ্ছে একটি চিন্তা প্রক্রিয়ার ভিত্তি যার মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়গুলো অর্জন, অনুধাবন এবং সেগুলো নিয়ে অন্যের সাথে যোগাযোগের সক্ষমতা তৈরি করতে সহায়তা করে। তাই একজন মানুষের চিন্তা ও প্রকাশের স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা নির্ভর করে সে মানুষটি তার মাতৃভাষার ওপর কতটা দখল রাখতে পারে তার ওপর। কোন একটি বিষয়ে দুর্বলতার অর্থ হচ্ছে নিদির্ষ্ট ওই বিষয়টির ওপর দখল না থাকা কিন্তু মাতৃভাষার ওপর দুর্বলতার অর্থ হচ্ছে চিন্তা ও প্রকাশ ক্ষমতার অবশতা বা নিস্ক্রিয়তা। দূরদৃষ্টি, উদ্ভাবনীশক্তি এবং ধারণার প্রকাশ ও বিনিময় করার সক্ষমতা তখনই তৈরি হয় যখন একজন মানুষ একটি নিদির্ষ্ট বিষয় ভালোভাবে বুঝতে, অনুধাবন করতে এবং হৃদয়াঙ্গম করতে পারে এবং ওই নিদির্ষ্ট বিষয়টির ভিত্তিকথায় উদ্দীপ্ত হয়। সেক্ষেত্রে মাতৃভাষা একমাত্র পথ বা উপায় যার মাধ্যমে একজন মানুষ নিদির্ষ্ট বিষয়বস্তু অনুধাবন ও হৃদয়াঙ্গম করতে পারে। যেমন: একটি খাসি শিশুকে সততা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি খাসি ভাষা ব্যবহার করা হয় তাহলে ওই বিষয়টি সহজে ওই শিশু অনুধাবন ও হৃদয়াঙ্গম করতে পারে যেটা বাংলাভাষায় তার পক্ষে সম্ভব নয়।

চার
বিশ্বের ৬ হাজার অধিক ভাষার মধ্যে প্রায় ৫০% বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। বলা হয়, প্রতি ১৪ দিনে এক একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়। একটি ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে সেই ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্য, ইতিহাস, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পরিবেশ, উত্তরাধিকার এবং সংস্কৃতিও বিলুপ্ত হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষার চাপে ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলো হারিয়ে গেছে। এটি সূচিত হয়েছে মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ‘সরকারি ভাষা’ নীতির কারণে। অথবা ছোট জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোকে প্রলুদ্ধ করা হয় যে, ‘সরকারি’ অথবা ‘আন্তর্জাতিক’ ভাষায় কথা বললে তাদের সম্মান বাড়বে। প্রাধান্যশীল বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর চর্চা ও প্রচার বেশি হওয়ার কারণে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সেই ভাষা চর্চা করে, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার মাধ্যম হয় ওই ভাষায়। ফলে নিজ ভাষাটি ঠিকমতো রপ্ত করার আগেই তাদেরকে অন্য ভাষার চর্চার দিকে অধিক মনোযোগী হতে হয়। তাদের সন্তানেরা শিক্ষিত হয়ে নিজ ভাষার চর্চা না থাকায় আস্তে আস্তে তাদের সেই ভাষা বিলুপ্ত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফিলিপাইনের উত্তরাঞ্চলে লুজন প্রদেশের মানুষের ব্যবহৃত Arta ভাষাটি আজ বিলুপ্ত। দেশটিতে তালিকাভুক্ত মোট ১৭৫টি লিখিত ও কথ্য ভাষা রয়েছে তবে এর মধ্যে ৪টি ভাষা একেবারে বিলুপ্ত হয়েছে ওই ভাষায় কথা বলার মানুষ না থাকার কারণে। একইভাবে রাশিয়ার Ket ভাষাটিও আজ বিলুপ্ত প্রায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডালু, খাসি, পাত্র, মাহালিসহ আরও অনেক আদিবাসী ভাষা রয়েছে যেগুলো আজ প্রায় বিপন্ন। বলা চলে, বাংলাদেশের সব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাই আজ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাঁচ
বলা হয়, একটি ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে আমরা একটি ছবি বা চিত্র হারাই, যেটাকে নিয়ে আমাদের মস্তিস্ক হয়তো চিন্তা করার উপলক্ষ পেতো! কারণ ভাষা নিয়ে গবেষণা করা হলে মানবজাতি কীভাবে জ্ঞার্নাজন এবং যোগাযোগ করে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রকৃতির সাথে তাদের সম্পর্ক, সম্পদব্যবস্থাপনা, ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা জানা যায়, যা এখনও পর্যন্ত হয়তো বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে তথ্যায়িত হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বের অনেক ভাষার মৌখিক গান, সাহিত্য, রূপকথা, প্রবাদবাক্য রয়েছে যেগুলোর লিখিত কোন রূপ নেই। ওইসব ভাষা বিলুপ্ত হওয়া মানে এসব সাহিত্য ও সঙ্গীতের চিরতরে বিলীন হওয়া। তাই ভাষাকে রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কোনভাবেই মাতৃভাষাকে বিকৃত করা যাবে না। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সবাই অনুরোধ করেছেন যাতে বাংলাভাষাকে বিকৃত করা না হয়। অফিস-আদালত থেকে শুরু সর্বস্তরেই মাতৃভাষার ব্যবহার ও শুদ্ধ উচ্চারণ নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে দেশের বিভিন্ন ভাষার মানুষের মাতৃভাষাকে সম্মান করার উদারতা দেখাতে হবে। তাদের নিজ নিজ ভাষায় অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা স্তর পর্যন্ত শিক্ষালাভ করার উদ্যোগ নিতে হবে যাতে তারা তাদের ভাষা রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে পারে।

happy wheels 2