“পুরাতন জিসিন কি ডিম পাড়ে?”- আসুন বেচে দিই!

মানিকগঞ্জ থেকে বাহাউদ্দীন বাহার

বছরখানিক আগে টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুক কিংবা পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন বেশ চোখে লেগেছিল, কানে বেজেছিল। আর সেটি হল বিক্রয় ডটকমের ‘পুরনো জিনিস কি আর ডিম পাড়ে? ছবি তুলুন, পোস্ট করুণ আর বেচে দিন’। একই সময়ে ভারতীয় টেলিভিশনগুলোতে একই ধরণের বিজ্ঞাপন ‘পুরনো জিনিস কে ধরে না রেখে বেচে দিন।’-OLX.COM এর। সত্যিই তো পুরনো জিনিস কি ডিম পাড়ে? সুতরাং তাকে বেচে দিন?

পুরনো জিনিসের কি ডিম পাড়া ছাড়া আর কোন মূল্য নেই? আপনার বাবার দেয়া জীবনের প্রথম ‘ঘড়ি’; হাতে দিতে পারেন না-ওল্ড ফ্যাশান বলে! কি আর করা বেচে দিন। আপনার বিয়ের প্রথম লাল টুকটুকে ৪০ বছরের পুরনো শাড়ী-কি আর কাজে লাগবে? বেঁচে দিন। আমার বাবার একটি ৩৭ বছরের পুরনো সাইকেল আছে-আমারই চালাতে বেশ কষ্ট হয়। তবু বাবা সাইকেলটা এখনো চালান। সাইকেলটা তার শ্বশুর তার বিয়ের সময় তাকে উপহার দিয়েছিলেন। সাইকেলটা তো আর নতুন সাইকেল দেবে না! বরং মেইনটেনেন্সের জন্য প্রতিনিয়ত খরচ হবে। আমার বাবা কি সেটা বেচে দেবে? বেঁচে থাকতে তো নয়ই।

পুরনো মূল্যবোধ, সংস্কার, ভালোবাসা, বিশ্বাস-আস্থা ধরে রেখে লাভ কি বেচে দিই। ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি, শুনে এসেছি, শিখে এসেছি এবং বেচে এসেছি পুরনো জিনিস। পুরনো ছেড়া-ফাটা, ভাঙ্গাচুরা জিনিস দিয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চকলেট, আইসক্রিম, পাঁপড় ভাজা কিংবা বিনিময়ে মা-চাচীরা নিয়েছে ঘরের প্রয়োজনীয় হাড়ি-পাতিল। এগুলোর কি কোন প্রভাব নেই আমাদের জীবনে? এর বিন্দুমাত্রা রেশ কি নেই আমাদের মগজে?gfgfgf

এগুলো দেখতে-দেখতে, শুনতে-শুনতে আর করতে করতে যখন আমাদের নিজেদের জীবনে কোন পুরাতন, বৃদ্ধ, জরাজীর্ণ ঘরের মানুষকে দেখি-যারা হয়তো আপনার আমার বাবা-মা, দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানী যারা সারাদিন ঘরের কোনে বসে থাকে; ডিম পাড়ার জন্য। কিন্তু দিন শেষে কোন ডিমই পারে না। তখন কি বলতে ইচ্ছে করে না-ধুর এই বুড়া গুলো তো ঘরে বসে ডিমও পারে না; বেঁচে দিই বিক্রয় ডট কম কিংবা ওএলএক্স ডট কমের মতো কোন কম্পানি কিংবা ফেরিওয়ালার কাছে। জায়গাও বাঁচল, ঝামেলাও কমলো। সেই ফেরিওয়ালা হয়তো কোন ওল্ড এজড হোম কিংবা বৃদ্ধাশ্রম। কিংবা আমাদের বৃদ্ধ মানুষ বেচার মতো কোন কোম্পানি নেই বলে হয়তো ফেলে রাখি বাড়ির সবচেয়ে অন্ধকার ঘুপচি ঘরটিতে। কোন যত্ন নেই, আদর নেই, খোঁজ খবর নেই। পুরনো মানুষটার পিছনে যে অর্থ আর ওষুধ খরচ হয় সেটাও বুঝি বৃথা অপচয়।

ভাবছেন আমার কথার কোন ভিত্তি নেই। ভেবে দেখুন, আপনার বাসার পুরাতন দৈনিক পত্রিকাগুলো কি করেন ফেলে রাখেন সবচেয়ে অন্ধকারের ঘুপচিতে। তারপর যখন আর জায়গা হয় না তখন বেঁচে দেন কাগজওয়ালার কাছে। বাসার যত পুরাতন অব্যবহার্য, কাজে লাগে না এমন জিনিস আপনি কি বেঁচে দেন না একেবারে নামমাত্র মুল্যে? তাহলে ঠিক সেই একই আচরণ কি করেন না বাড়ির সবচেয়ে পুরাতন সদস্য-যিনি কোন কাজের না, বাসার জায়গার অপচয়। হয়তো সে আপনার আপনজন বলে বেচতে পারছেন না। কিংবা বেচার কোন সুযোগ নেই বলে হয়তো। জানি না যদি কোন দিন সুযোগ তৈরি হয়-তাহলে আমিও হয়তো বেচে দিতে পারি আমার পরিবারের পুরাতন সদস্যকে!

3434আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে বাসার পুরাতন জিনিস আর পুরাতন/বৃদ্ধ মানুষ কি এক? নিশ্চয় না। কিন্তু এই যে পুরনো জিনিসের প্রতি আমাদের দীর্ঘ দিনের আচরণ, অভিব্যক্তি, ব্যাখ্যা কি কোন প্রভাব ফেলে না আমাদের মানুষের সাথে আচরণ কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে? বা আমাদের মনস্তত্ত্বে? যদি আপনার উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়। তাহলে অবশ্যই সেটা মারাত্মক।

দ্বিতীয় আর একটি প্রশ্ন মাথায় আসতে পারে। এই পুরনো জিনিসগুলো নিয়ে আমরা কি করবো? কোন কাজে লাগে না আবার অনেকখানি জায়গা নষ্ট হয়। বেচে দিলেই তো ভালো। একবারও কি ভেবেছেন আপনার এই পুরাতন, অকাজের জিনিসগুলো যারা নামমাত্র মুল্য দিয়ে কিনে নেয়- তারা কি করে? তারা কি আপনার মতো ফেলে রাখে? কক্ষনো নয়। সেটাকে কাজে লাগায়, ব্যবহার করে। কক্ষনো একটু মেরামত করে কিংবা একবারে রিসাইকেলিং করে ভিন্ন কিছু তৈরি করে ব্যবহার করে। কিন্তু আপনি কি কক্ষনো আপনার পুরাতন জিনিসটাকে রিসাইকেলিং করে ব্যবহার করার কথা ভেবেছেন? কিংবা আপনার সন্তানককে কি শিখিয়েছেন? যদি উত্তর ‘না’ হয় তাহলে-সে কীভাবে শিখবে যে পুরাতন জিনিসেরও মূল্য আছে। পুরাতন জিনিসের যেমন মূল্য আছে তেমনি মূল্য আছে আপনার পরিবারের সবচেয়ে পুরাতন সদস্যেরও। তার অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং দেখাশুনার অশেষ মূল্য আছে আপনার এবং আপনার পরিবারে।

আপনার পরিবারের সকলেই ব্যস্ত। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে সময় দেয়ার কেউ নেই। আপনার পরিবারের প্রবীণ সদস্য হতে পারে সবচয়ে কার্যকরী। আপনার বাসায় কাজের লোক আছে কিন্তু আপনার স্কুল পড়ুয়া ছোট সন্তানকে বাসায় রেখে যেতে পারছেন না। শুধু যদি একজন প্রবীণ সদস্য থাকে তাহলে এই জটিল সমস্যার সমাধান নিমিষেই হবে। আপনার ছোট কংক্রিটের বাসাটা সবুজ আর প্রাণে ভরে তুলতে পারেন প্রবীণ সদস্যটি। নাগরিক ব্যস্ততা আর সমস্যায় একবারে বিপর্যস্ত। একটুও শান্তি পাচ্ছেন না। কারোর সাথে শেয়ার করতে পারছেন না। আপনার প্রবীণ অভিজ্ঞ বাবা-মা, দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানি অথবা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে একটু সময় কাটান, মন খুলে গল্প করুন। জানি তিনি হয়তো আপনার সমস্যার সমাধান করে দেবেন না। কিন্তু আমি নিশ্চিত আপনি কিছু অনুপ্রেরণা আর সাহস পাবেন। নতুন আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠবেন। হয়ে উঠবেন এক নতুন আপনি।

একটু ভাবুন বাড়ির পুরাতন জিনিসটার যেমন হয়ে উঠতে পারে মূল্যবান। ঠিক তেমনি আপনারা পরিবারের প্রবীণ সদস্যও কম মুল্যবান নয়। আপনিও যেমন বিষয়টা আমল করবেন। তেমন করে শেখান আপনার সন্তানকেও। নতুবা আমি আপনিও হয়ে যাবো প্রবীণ-পুরাতন এক বৃদ্ধ। তখন আপনার আমার সন্তান যেন আমাদেরকে পুরাতন ভেবে বেচে না দেয়-‘ডিম পাড়ি না বলে!’

 

happy wheels 2