কেমন আছে আমাদের সন্তানেরা!
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল:
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’-কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কথা এটি। বর্তমান সময়ে আমাদের সন্তানরা দুধে ভাতে থাকার চাইতেও থাকছে নানান সামাজিক সংকটের মধ্যে। যে কারণে আজকের প্রজন্ম একটি সংকটাপন্ন সময়ের মধ্য দিয়ে তাদের দিন অতিবাহিত করছে।
গতকাল একটি হেয়ারিং হেবিলিটেশন সেন্টারে বাবার একটি টেস্ট করানোর জন্য কিছু সময় ছিলাম। সেখানেই দেখা হলো এক দম্পতির সাথে। খুবই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার, পরিপাটি বেশভূষা তাদের। একমাত্র সন্তানটির নাম মুগ্ধ, বয়স ২ বছর। কিন্তু সে স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না। প্রশ্ন করাতে যেটা জানা গেল- আরো ছোট বেলা থেকে (যখন তার বাবা-মার সাথে কথা বলা প্রয়োজন) সে মোবাইল আর ট্যাব নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তাই যেকোন যান্ত্রিক শব্দ হলে সে যেখাবে রেসপন্স করে। কোন মানুষ ডাকলে সেভাবে রেসপন্স করে না। যার পরিণতিতে সে এখন কিছুটা বাক প্রতিবন্ধি হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে সেন্টারের একজন জানালেন, “তাদের সন্তানটি যন্ত্রের সাথেই যেহেতু বেশি সময় কাটিয়েছে, তাই তার অভ্যস্থতা তৈরি হয়েছে যন্ত্রের সাথে। কথা বলা ও যোগাযোগ করাও যন্ত্রের সাথে। এর কারণ হলো বাবা-মা’র সন্তানকে সময় না দেয়া বা তাকে যন্ত্র নিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা। যার ফলে সে এখন আর কোন মানুষের ডাকে সাড়া দেয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। কিন্তু কোন যান্ত্রিক শব্দ হলেই সে সেদিকে মনোযোগ দেয়।”
আমরা ছোট একটি পরিবার নিয়ে একটি এপার্টমেন্ট এ থাকি। সেখানে প্রায় ৪৮ টি পরিবার বসবাস করে। একদিন ছাদে বিকাল বেলায় হাঁটতে গিয়ে দেখলাম ৮-১০জন শিশু ছাদে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছে। আমি তাদেরকে কিছুটা সময় দিলাম। আর তাতেই তারা দারুণ উৎফুল্ল। এরপর তাদের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করলাম খেলাধূলার কি খবর। তারা জানালো এখন আর ছাদে খেলা যায় না । বাড়ীর ম্যানেজার মানা করেছে সেখানে খেলতে। উল্লেখ্য, আমি যে এলাকায় থাকি সেখানে আশপাশে কোন মাঠ নেই; যেখানে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারে।
ঢাকার অধিকাংশ এলাকার শিশুরা তাদের অধিকাংশ সময় কাটায় চার দেয়ালের মধ্যে। তাদের বিনোদন বলতে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাব, বিভিন্ন যান্ত্রিক খেলনা, প্রভৃতি। তাদের ঘুমভাঙ্গা থেকে ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত সময় কাটে সকল যান্ত্রিক ডিভাইজের সাথে। বাবা-মা, ভাই-বোনদের সাথেও তাদের খুব সামান্যই কথা হয় বা সময় কাটে। খুব কম শিশুই তাদের খাবার গ্রহণ করে হাতে যান্ত্রিক খেলনা ছাড়া। যেমন হাতে ট্যাব নিয়ে খেলছে আর এর মধ্যে মা সন্তানকে খাইয়ে যাচ্ছে। অথবা ল্যাপটপে কার্টুন ছবি ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। তাদের নেই কোন শারীরিক পরিশ্রম। সবুজ মাছে ছুটে বেড়ানো, খেলাধুলা, দাদা-নানুর কাছে গল্প শোনা, ভূতের গল্প শুনে ভয় পাওয়া, কোন কিছুই তাদের আর স্পর্শ করে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমান প্রজন্মের মানবিক দিকগুলো থেকে শিশুদের বিকাশ প্রায় রুদ্ধ। যন্ত্র নির্ভরতা, পরিবার ও সমাজ বিচ্ছিন্নতার কারণে সে তার সুকুমার বৃত্তি থেকে বের হয়ে আসছে। যার ফলে পরিবারে বড় হয়েও তার মধ্যে কোন মানবিকতা ও সৃজনশীলতা তৈরি হচ্ছেনা বললেই চলে। অন্যদিকে পরিবারে বাবা মা’র সময় দেয়ার অভাব এবং মানসম্মত সময় সন্তানদের সাথে না দেবার কারণে তার বেড়ে উঠা হচ্ছে এক ধরণের প্রচলিত গড্ডালিকা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে। সন্তান কখন খায়, কি খায়, কি তার পছন্দ, কার সঙ্গে থাকে, কি রং ভাল লাগে আর কখন ঘুমায় কোন তথ্যই বাবা-মা’র কাছে থাকে না। যার ফলে সন্তানদের বেড়ে ওঠাতে পরিবারের ভূমিকা হয়ে পড়ছে খুবই গৌণ। এ পরিস্থিতিতে অধিকাংশ সন্তান হয়ে পড়ছে নি:সঙ্গ। এই নি:সঙ্গতাকে তাকে নিয়ে যাচ্ছে নানান অসামাজিক কর্মকান্ডের দিকে। কেউ কেউ হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত।
এ বিষয়ে একজন শিশু কিশোর সংগঠক ও বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: লেলিন চৌধুরী বলেন, “সভ্যতার অগ্রগতি হচ্ছে অসমভাবে। প্রযুক্তির একটি অংশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের জীবন সেভাবে এগুচ্ছে না। এক কথায় প্রাণ-প্রকৃতির ও জীবনের সাথে প্রযুক্তির সম অগ্রগতি হচ্ছে না। কিন্তু সভ্যতা এগুচ্ছে। যন্ত্র, আলো ও শব্দের সহনীয় মাত্রা যেভাবে থাকা দরকার সেভাবে না রেখে নগরায়ন হচ্ছে। ফলে প্রতিটা জীবনই ক্রমাগত যন্ত্রনির্ভর এবং চাপগ্রস্থ হচ্ছে। কম্পিউটারে গেম খেলতে গিয়েও এখন একটি তরুণ প্রাণ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “ সভ্যতার অগ্রগতির এই জায়গায় এসে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আরো সংবেদনশীল না হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম হবে আরো যান্ত্রিক। এই যান্ত্রিকতা থেকে উত্তোরণের জন্য এই সভ্যতার একটি সম উন্নয়ন প্রয়োজন যেখানে প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবনকে কেন্দ্র করেই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটবে।”
কবি সুকান্ত বলেছিলেন, “এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আকার দৃঢ অঙ্গিকার।” কিন্তু আমরা কি এ বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলতে পারছি? আমাদের যান্ত্রিক দুনিয়ার সকল বাহাদুরিই আজ এ প্রজন্মকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে। আসুন আমরা আমাদের চিরায়ত যুথবন্ধ পরিবার ও সমাজের চর্চায় ফিরে যাই। যেখানে সকল শিশুই তার সুন্দর সুকুমার বৃত্তি নিয়ে হাসি আনন্দে বেড়ে উঠবে। কোন যান্ত্রিকতার কাছে সে বন্দি থাকবে না।
* ছবিগুলো ইন্টারনেট এর মুক্ত সোর্স থেকে নেয়া।