সাম্প্রতিক পোস্ট

শস্যবিমা

ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম

প্রেক্ষিত
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও চলমান অগ্রগতিতে কৃষিখাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রতিনিয়ত কৃষিব্যবস্থার ওপর নতুন নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। দেশের প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি প্রতি বছর খরায় আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দেয়ার ফলে নদীর কাছাকাছি এলাকার জমিতে পলি পড়ে উঁচু হয়েছে কিন্তু বাঁধের ভেতরে বেসিনের মতো নিচু হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে। এরকম জলাবদ্ধ জমির পরিমাণ প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিগত ৪০ বছরে লবণাক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ২৭% বেড়েছে। নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে লবণাক্ত পানি সমুদ্র থেকে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে। ফলে স্বাভাবিক কৃষিকার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমির পরিমাণ এক মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি। বাংলাদেশে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ৮,৩০,০০০ হেক্টর আবাদি জমির ক্ষতি করেছে। প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি হাওর কিংবা বিল এলাকায় অবস্থিত এবং হাওরাঞ্চলের পানি সময় মতো বের না হওয়ায় চাষাবাদ বিঘ্নিত হয়। কোনো কোনে বছর এপ্রিল মাসে আগাম বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হওয়ার ফলে অকাল বন্যায় হাওরে কৃষকের শত শত কোটি টাকার ফসলহানি হয়। অসময়ে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও মৌলভীবাজারের হাওরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে এলাকার কৃষক বেঁচে থাকার প্রধানতম অবলম্বন বোরো ধান ও সবজি তলিয়ে যায়।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের দেশের আবহাওয়া অনবরত বদলে যাচ্ছে। ফলে কৃষিক্ষেত্রে ফসলের সময়মতো উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশের কৃষির গতি-প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশের কৃষি প্রতিনিয়ত প্রকৃতির বৈরী পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে এগিয়ে চলছে। অসময়ে খরা, বন্যার কারণে একদিকে কৃষক হারিয়ে ফেলছে অতি মূল্যবান ফসলসহ নানা জাতের বীজ, অন্যদিকে মাটি হারাচ্ছে ফসল উৎপাদনশীলতা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের কৃষি নির্ভরশীল ক্ষুদ্র খামারভিত্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে এসব সমস্যা মোকাবিলা করে, খাদ্যউৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তার লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ আমাদের জন্য খুব জরুরি। এছাড়াও কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা, টেকসই কৃষিউদ্ভাবন ও বৈরী আবহাওয়ার সাথে খাপখাইয়ে পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন অতি অবশ্যকীয়। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত যেমন-লবণাক্ততা, উচ্চ তাপমাত্রা, খরা কিংবা বন্যা মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি টেকসই কৃষি উৎপাদনের পূর্বশর্ত। তাই কৃষকের ক্ষতি বা ধ্বংস পুষিয়ে নেবার জন্যে শস্যবীমা চালুকরণ সময়ের দাবি যা অঞ্চলভিত্তিক কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিত।

শস্যবিমা ও শস্যবিমার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
শস্যবিমা হলো এমন একটি চুক্তি যা একজন বিমাগ্রহীতা কৃষক ও একটি বিমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পাদিত হয়; যেখানে বিমা প্রতিষ্ঠান এই মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করে যে বিমা গ্রহীতা কৃষকের ফসলের ক্ষতি হলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিমা গ্রহীতাকে প্রদান করা হবে। এটি অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। তাই শস্যবিমা হচ্ছে কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শস্যবিমা সুরক্ষার আওতায় থাকে কৃষক, মৎস্য চাষি, গবাদি পশুপাখি পালনকারী ও কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ঠ অন্যান্য চাষি। বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশে আমাদের দেশে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ খরা, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ঘটে থাকে যা কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের আর্থিক ক্ষতি সাধন করে। ফলে গোটা দেশের খাদ্য উৎপাদন ও অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। শস্যবিমার মাধ্যমে কৃষি আয়ের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা এবং সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে কৃষি ও কৃষককে নিরাপত্তা বা সুরক্ষা প্রদান করা হয়। শস্যবিমা তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে কৃষককে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই শস্যবিমা পরিষেবার ব্যবস্থা রয়েছে যা কৃষি ও কৃষককে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ১৯৪০ সালে পৃথিবীতে প্রথম শস্যবিমা চালু করে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আবার এই উপমহাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম কৃষক পর্যায়ে তুলা ও চীনাবাদামের উপর শস্যবিমা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে তা বন্ধ হলেও ১৯৭৯ সালে আবার পাইলট স্কিমের আওতায় এলাকা ভিত্তিক শস্যবীমা চালু করা হয়। ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও মেক্সিকোসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল ও কৃষিপ্রধান দেশে ইতোমধ্যে এই বিমা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

বাংলাদেশে সাধারণ বিমা কর্পোরেশন’র আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমা প্রকল্প
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শস্যবিমা অনেক আগেই প্রবর্তন করা হয়েছে। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন পরে পুনরায় কৃষকদের পক্ষ থেকেশস্যবিমা চালুর দাবি উঠছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, জলোছ¡াস, শিলাবৃষ্টি ও পোকামাকড়ের আক্রমণে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষককে রক্ষার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার শস্যবিমা প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের উপর। প্রাথমিক ভাবে দুটি জেলার দুটি উপজেলা বাছাই করে পরীক্ষামূলকভাবে শস্যবিমা পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। নির্বাচিত উপজেলা গুলোর অনুন্য ৫ টি কৃষক সমবায় সমিতিকে শস্যবিমার আওতায় আনা হয়। দুর্যোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণের মতো আপদে বিমার ঝুঁকি গ্রহণ করা হতো। জমিতে ৫ বছরের উৎপাদিত ফসলের গড় মূল্যের ভিত্তিতে বিমাংক নির্ধারণ করা হতো। বিমাকারীর দায় উক্ত বিমাংকের শতকরা ৮০ ভাগ ছিল, যা বিমাকৃত পুঁজি হিসাবে ধরা হতো। ১৯৯৫ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। মূলত সরকারী ভর্তূকী বা রি-ইন্সুরেন্স সুবিধা না থাকা, কারিগরী সহযোগিতার অভাব এবং সরকারের সুনির্দিষ্ট কোন নীতি বা লক্ষ্য না থাকায় প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। এছাড়া প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা কর্তৃক মাঠ পরিদর্শনের পর দাবি পরিশোধ করা হতো বিধায় এটি ছিল সময় সাপেক্ষ ও বিরক্তিকর পদ্ধতি। এসব নানা কারণে প্রকল্পটি সে সময় বন্ধ হয়ে যায়।

২০১৩ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে কৃষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনের লক্ষ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এর অনুদানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা কর্পোরেশন (এসবিসি) ও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) কর্তৃক রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বিমা চালু করেছে যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষকদের জন্য একটি অতিগুরুত্বপূর্র্ণ পদক্ষেপ। বাংলাদেশের জন্য এর মূল উদ্দেশ্যই হলো-আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমার মাধ্যমে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি হ্রাস করা। আবহাওয়া কেন্দ্র হতে প্রাপ্ত আবহাওয়া বিষয়ক সম্ভাব্য আগাম তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ বিমা পলিসি প্রস্তুত করা হয় এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই বিমা দাবি পরিশোধের বিধান রাখা হয়।

প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমার মাধ্যমে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি হ্রাস করা। আবহাওয়া কেন্দ্র হতে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ বিমা পলিসি প্রস্তুত করা হয় এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই বিমা দাবি পরিশোধ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় প্রকল্পভুক্ত জেলায় মোট ২০টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া কেন্দ্র্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রকল্পভুক্ত তিনটি জেলায় মোট ৪টি পাইলটিং এর মাধ্যমে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৬,৭৭২ জন কৃষকের অনুকূলে অতি বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টিজনিত ঝুঁকি অন্তর্ভূক্ত করে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমাপত্র ইস্যু করা হয়েছে। প্রথম তিনটি পাইলটিং এর আওতায় আমন ধান ও আলু ফসলের অনুকূলে ৫,৩৯৯টি আবহাওয়া সূচক ভিত্তিক শস্যবিমাপত্র ইস্যু করা হয়েছে। উক্ত বিমা পলিসির বিপরীতে উত্থাপিত বিমা দাবি ১৭,৫৪,৩১৪.০০ টাকা বিমা গ্রহীতা কৃষকদেরকে সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের নিজস্ব তহবিল হতে পরিশোধ করা হয়েছে।

প্রকল্পের ৪র্থ পাইলটিং এর আওতায় প্রকল্পভুক্ত তিনটি জেলায় বোরো ধানের বিপরীতে মোট ১,৩৭৩টি পলিসি ইস্যু করা হয়েছে এবং ভ্যাটসহ ৮,৪৮,২৪০.০০ টাকা প্রিমিয়াম অর্জিত হয়েছে। উক্ত পলিসিসমূহের বিপরীতে মোট ৩২,৮৩,১০০.০০ টাকা বিমাদাবি সাধারণ বিমা কর্পোরেশন কর্তৃক পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে নোয়াখালী জেলায় ৪২৬ বিঘা জমির অনুকূলে ৪০০ টি আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমা পলিসি ইস্যু করা হয়েছে এবং ইস্যুকৃত পলিসির বিপরীতে উত্থাপিত বিমা দাবি ৩,৭০,১০০.০০ টাকা সাধারণ বিমা কর্পোরেশন কর্তৃক পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উক্ত বিমা পলিসির বিপরীতে কৃষকদের বিঘা প্রতি ভ্যাটসহ মোট প্রিমিয়াম ছিল ৬৯০.০০ টাকা। তন্মধ্যে সরকার কর্তৃক বিঘাপ্রতি ভ্যাটসহ প্রিমিয়াম বাবদ ৩৯০.০০ টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট প্রিমিয়াম ৩০০.০০ টাকা কৃষকদের নিকট হতে গ্রহণ করা হয়েছে। রাজশাহী জেলাতেও বিগত ২০১৭ সালে ৫ম পাইলটিং এর মাধ্যমে আমন ধানের অনুকূলে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমা পলিসি ইস্যুর কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।

প্রকল্পেন আওতায় এফজিডি, ট্রেনিং এবং বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১৩,৫৪৪ জন কৃষককের মধ্যে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। পাশাপাশি ট্রেনিং প্রোগ্রাম/ওয়ার্কশপ/সেমিনার এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের ৯০০ জনেরও অধিক কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমা বিষয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে রাজশাহী জেলায় ৫ম পাইলটিং এর মাধ্যমে আমন ধানের অনুকূলে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমা পলিসি ইস্যুর কার্যক্রম চলছে (তথ্যসূত্র: সাধারণ বীমা কর্পোরেশন কর্তৃক প্রকাশিত বুলেটিন)

কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষক ও ফসলের দুর্যোগ শুধু আবহাওয়া সূচকে বিবেচনা করলে হবে না। ভৌগোলিক কারণেও এখানে নানা মাত্রায় দুর্যোগ হয়ে থাকে। নদী মাতৃক দেশে নদী ভাঙ্গন ছাড়াও ফসলে রোগ-পোকার আক্রমণ, রাসায়নিক ও বিষের প্রতারণা, মাত্রারিক্ত বা ভুল ওষুধ প্রয়োগ, বীজের সমস্যা, বীজ নিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়া ইত্যাদি দিকগুলো। অঞ্চলভেদে আবার এইসব দুর্যোগের সংঘটন এবং মাত্রাও ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চলে বন্যা হয় না। এখানে খরা এবং শীত-শৈত্য প্রবাহ, ফসলে রোগ পোকার আক্রমণসহ মনুষ্য সৃষ্ট নানা দুর্যোগ (বর্তমান সময়ে পুকুর খননে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বিলের ফসল হানি) দেখা যায়। শস্যবিমার পাইলটিং কার্যক্রম শেষে এটি স্থায়ী রূপ লাভ করবে ও সম্প্রসারিত হবে কৃষকরা এমনটাই প্রত্যাশা করেন।

বেসরকারী উদ্যোগে শস্যবিমা কার্যক্রম
কৃষকদের জন্য শস্যবিমা চালু করেছে আরডিআরএস-বাংলাদেশ। দেশে বেসরকারীভাবে প্রথম কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন’র আর্থিক সহায়তায় এই প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া সিনজেন্টা ফাউন্ডেশন স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে ঠাকুরগাঁও জেলায় স্বল্প পরিসরে শস্যবিমা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

পশ্চিম বঙ্গের ‘বাংলা শস্যবিমা’: কৃষকের পক্ষে যার প্রিমিয়াম দেয় রাজ্য সরকার
কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বা অন্য কোনো কারণে কৃষকের ফসল নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এই ‘বাংলা শস্যবিমা যোজনা’ প্রকল্প প্রচলন করেছে। পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা কোনো কৃষক তিনি জমির মালিক অথবা ভাগচাষী হোন সবাই ’বাংলা শস্যবিমা’ প্রকল্পের সুবিধা পান। এর জন্য কৃষককে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না। রাজ্য সরকারই প্রিমিয়ামের টাকা জমা করে থাকে। শুধুমাত্র আলু এবং আখ এই দুটি বাণিজ্যিক ফসলের জন্য কৃষককে সর্বাধিক ৪.৮৫% প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়। কৃষকরা চারটি পর্যায়ে বিমার টাকা হাতে পায় প্রথমত, শস্য বোনার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হলে, দ্বিতীয়ত, চাষের সময় কোনো ক্ষতি হলে, তৃতীয়ত, ফসল কাটার সময় তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এবং চতুর্থত, আবহাওয়ার কারণে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে।

এই স্কিম অনুসারে কৃষকদের বিমা কভারেজ পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতির সঠিক প্রমাণ এবং জমির দলিলসহ প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হয়। বিমার টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করেন রাজ্য সরকার। হেক্টর প্রতি হিসাবেই ওই বিমার টাকা তুলে দেওয়া হয় কৃষকের হাতে। পশ্চিম বঙ্গের ১৫টি জেলার কৃষকের জন্য বিগত ২০১৯ সালের খরিফ মৌসুমের এই বিমার অন্তর্ভূক্ত ফসলগুলি ছিল আউশ এবং আমন ধান, পাটও ভুট্টা। তবে বিমার জন্য মৌসুম ও জেলা ওয়ারী প্রতিবছর ফসল নির্ধারিত হয়। বিমা সচেতনতার জন্য সরকার ও বিমা সংস্থাগুলির মধ্যে চুক্তি অনুসারে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ব্লকে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

প্রত্যাশার আগামী
বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যশস্য বিশেষত ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সফলতা লাভ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এ সফলতার মূল ভিত্তি রচনা করেছেন এদেশের ক্ষুদ্রও মাঝারি কৃষক। তাই আমাদের গ্রামীণ কৃষক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তায় শস্যবিমা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আসন্ন বাজেটে সুনির্দিষ্ঠ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। একই সাথে সরকারি ও বেসরকারি স্বনামধন্য বিমা কোম্পানি ও এনজিও কষকদের স্বার্থ সুরক্ষায় শস্যবিমা কার্যক্রম চালুর মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। কেননা শস্যবিমা কৃষিতে বিদ্যমান প্রাকৃতিক বৈরী প্রভাবের বেড়াজালে আটকে পড়া কৃষককে শুধু রক্ষাই করবে না বরং তার কৃষিকে লাভজনক করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে, যা দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকেও মজবুত করবে।

happy wheels 2

Comments