আলোকিত মানুষ আব্দুর রহমান
বাংলাদেশে হাওর-বাওর অধ্যুষিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসি হিল্স এর সীমান্তঘেঁষা একটি জেলা নেত্রকোণা। বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ও ধার্মিক ব্যক্তিত্ব এ অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করে এলাকার কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সমাজসেবায় নেত্রকোণার ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহম্মেদ, শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কমরেড মনি সিংহ, গোলাম মোস্তফা জব্বার, প্রফেসার যতীন্দ্র সরকার উল্লেখযোগ্য। এসব বিখ্যাত মানুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চল্লিশা গ্রামের সাধারণ একজন কৃষক আব্দুর রহমানও (৭৩) চেষ্টা করেছেন কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ সেবা ও পরিবেশ উন্নয়নে তার অবস্থান থেকেই অবদান রেখে চলা। তাঁদের মতো তিনি হয়তো এত পরিচিত নন কিন্তু তার কর্মদক্ষতা, আগ্রহ ও জানার ও শেখার মানসিকতা থেকেই তাঁর গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামের মানুষের কাছে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর বিভিন্ন উদ্যোগ নানাভাবে মানুষের কল্যাণ করেছে, পথ দেখিয়েছে এবং সর্বোপরি উৎসাহ দিয়েছে জীবনপথে চলার। জন উন্নয়ন পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি তাঁর গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামে শিক্ষা ও জ্ঞান প্রসারেও ভূমিকা রেখেছেন। প্রচারবিমুখ এই মানুষটাকে নিয়েই বারসিকনিউজ.কম-এ আজ আমাদের এই আয়োজন। তাঁর জন্ম, পড়াশোনা, কর্মজীবন থেকে শুরু জীবনপথে চলার জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন সেগুলো নিয়েই চলতি এই লেখাটি সাজিয়েছেন নেত্রকোনায় বারসিক কর্মকর্তা শংকর ম্রং এবং মো. আলমগীর।
জন্ম, বেড়ে ওঠা ও জীবনসংগ্রাম
চল্লিশা গ্রামের একজন রেলওয়ে বিভাগের কমচার্রী মো. শেখ হাসেম আলী (হাসু) ও মা মোমজান এর পরিবারে ১৯৪৩ সালে আব্দুর রহমানের জন্ম। দুই ভাই বোনের মধ্যে তিনি বড়। গ্রামীণ পরিবেশে আব্দুর রহমানের বেড়ে ওঠা। ১৯৫১ সালের ১৭ জুলাই পিতার মৃত্যুর পর একমাত্র বোন ও মাকে নিয়ে টিকে থাকার জীবনযুদ্ধ শুরু করেন ৯ বছরে আব্দুর রহমানের। পিতার রেখে যাওয়া সামান্য জমিতে শাকসবজি চাষ করে অভাব-অনটনে সংসার চলে তাঁদের। অনেক চেষ্টার পর এবং তাঁর বাবার সহকর্মীদের সহায়তায় তিনি ১৯৬৬ সালে পোষ্য কোঠায় রেল কর্মী হিসেবে যোগদান করেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি সকালে এবং বিকেলে কৃষিকাজ করে সংসারের খরচ যোগাতেন। পড়াশুনার ইচ্ছা ছিল প্রবল। তাই রেল ষ্টেশনে দায়িত্ব পালনকালে যখনই সময় পেয়েছেন কৃষিসহ বিভিন্ন ধরণের লেখা বই সংগ্রহ করে পড়তেন। বই পড়ায় তার প্রবল আগ্রহ দেখে তৎকালীন এক রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে নেত্রকোণা নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। রেলওয়ের ডিউটি শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে নেত্রকোণা পাবলিক লাইব্রেরিতে অধ্যয়ন করতেন। তবে ১৯৭১ সালে ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আব্দুর রহমানের লেখাপড়ার ইতি ঘটে। যুদ্ধ শেষে তার আর স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তিনি মনোনিবেশ করেন চাকরি ও কৃষি কাজে। পড়ালেখায় তার প্রবল আগ্রহ দেখে বাহাউদ্দিন ও মোজাম্মেল নামে কলেজ পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী তাঁকে সহযোগিতা করেন। তিন বন্ধু মিলে দেয়াল পত্রিকা (দেয়ালিকা) লিখে সেগুলো বিভিন্ন স্কুলের দেয়ালে টানিয়ে দিতেন। দেয়ালিকায় বিভিন্ন গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ লেখায় অন্যান্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতেন এবং গ্রামীণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এলাকার ছেলে-মেয়েদের যুক্ত করতেন। বাহাউদ্দিন ও মোজাম্মেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য চলে গেলে পাশের গ্রামের সমবয়সী রমজান আলী নামে অন্য এক ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে রমজান আলীও পুলিশের চাকরি নিয়ে অন্যত্র চলে গেলে আব্দুর রহমান একাকী হয়ে পড়েন এবং বই-ই হয় তার একমাত্র বন্ধু।
সংসার জীবন
১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সালে স্ত্রী জাহেরা আক্তারকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন আব্দুর রহমান। দুই ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়েই তাঁর সংসার। নিজে বেশিদূর পড়াশুনা করতে না পারলেও তিনি পাঁচ সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। বড় ছেলে চল্লিশা হাইস্কুলের লাইব্রেরিয়ান এবং একটি কিন্ডার গার্টন স্কুলের পরিচালক, দ্বিতীয় ছেলে রেলওয়েতে চাকরি করছেন। তিন মেয়েকে পড়াশুনা শেষে বিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে এক মেয়ে একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে দুই ছেলে, দুই ছেলের বৌ ও দুই নাতি নিয়ে আব্দুর রহমানের ৮ জনের সংসার। কর্ম জীবনে আব্দুর রহমান ছিলেন একজন সাধারণ রেলওয়ে কর্মচারী ও শ্রমিক নেতা। তার ব্যবহার, কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্বের জন্য তিনি রেলওয়ে বিভাগের শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের নিকট খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। চাকরির অবসরে তিনি বন্ধুদের নিয়ে নিয়মিত গ্রামীণ বিনোদনের আয়োজন করতেন এবং এলাকার নিরক্ষরদের স্বাক্ষর শেখাতেন। যার জন্য রেলওয়েতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি হলেও অন্যত্র বদলি হতে হবে এবং এলাকা ছেড়ে এসব জনহিতকর কার্যক্রম থেকে দূরে থাকতে হবে ভেবে পদন্নোতি গ্রহণ না করে নিজ এলাকাতেই থেকে যান। তিনি একজন জনপ্রিয় শ্রমিক নেতাও। ১৯৮৬ সালে আব্দুর রহমান রেল শ্রমিক ইউনিয়নে যোগদান করেন এবং রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের গৌরিপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘদিন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৩ সালে ৫৭ বছর বয়সে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে পুরোদস্তর কৃষক বনে যান এবং কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও এলাকার পরিবেশের উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন।
জন উন্নয়ন পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
শৈশবের বই পড়ার নেশা থেকেই তার প্রবল ইচ্ছা ছিল একটি পাঠাগার গড়ে তোলার। কিন্তু সে ইচ্ছা বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি ২০১৩ সালে বাড়ি সংলগ্ন চল্লিশা বাজারে শাপলা কিন্ডার গার্টেন স্কুলের একটি কক্ষে একটি পাঠাগার গড়ে তোলেন এবং নামকরণ করেন “জন উন্নয়ন পাঠাগার”। অবসর সময়ে এলাকার লোকদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, এলাকার মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তৈরি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিনিময়ের মাধ্যমে কৃষক ও এলাকার মানুষের সমস্যা একে অপরের সাথে সহভাগিতা ও চিহ্নিত করে সমাধানের লক্ষ্যে তিনি এই পাঠাগারটি গড়ে তোলেন। এছাড়াও এলাকার পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কৃষি ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও বিভিন্ন প্রতারণা থেকে এলাকার মানুষকে সচেতন করাও পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য।
২০১৩ সালের আগে চল্লিশা গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের বসার একমাত্র স্থান ছিল বাজারে চায়ের দোকান। প্রবীণ নবীন সব শ্রেণীর লোক একই সাথে চা স্টলগুলোতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি আড্ডা দিতেন। প্রবীণদের বসার নির্দিষ্ট কোন স্থান ছিল না। প্রবীণরা চা স্টলে বসলে নবীনরা বসার জন্য সংকোচবোধ করত। পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার ফলে সমবয়সী প্রবীণরা আড্ডা দেয়া, বই, খবরের কাগজ পড়া ও আলোচনায় সময় কাটানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান পান। বিকেল চারটার দিকে পাঠাগারটি খোলার পর নবীন ও যুব প্রজন্ম আর সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত প্রবীণরা পাঠাগারটি ব্যবহার করেন। সারাদিন সাংসারিক কাজের ব্যস্ততা শেষে সমবয়সী প্রবীণরা এসে প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাঠাগারে আড্ডা দেন। কিশোর ও যুবকরাও বিকেলে জনপাঠাগারটিতে এসে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও জ্ঞার্নাজন করে থাকে। শিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞান জানা লোক ছাড়াও নিরক্ষর ও অভিজ্ঞ কৃষকরা পড়তে না জানলেও পাঠাগারটিতে এসে তাদের সমস্যা, অভিজ্ঞতা ও সফলতা অন্যদের সাথে সহভাগিতা করেন এবং আলোচনা অংশগ্রহণ করে নিজেদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করেন।
পাঠাগারের সদস্য ও বই
জন উন্নয়ন পাঠাগারের বর্তমানে প্রত্যক্ষ সদস্য সংখ্যা ৮১ জন (রেজিষ্টার অনুযায়ী)। প্রত্যক্ষ সদস্য ছাড়াও এলাকার ও বিভিন্ন এলাকার অনেক লোক এই পাঠাগারের পরোক্ষ সদস্য। বিভিন্ন শ্রেণী, বয়স ও পেশার লোক (অব: প্রাপ্ত পুলিশ, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, কৃষক, ব্যবসায়ী, ছাত্র-ছাত্রী) এই পাঠাগারের সদস্য। পাঠাগার গড়ে তোলার এই উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রখ্যাত লেখক ডা. লুৎফর রহমান, স্থানীয় সাহিত্যিক এমদাদ হোসেন খান, কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রমূখ ব্যক্তিদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন বলে আব্দুর রহমান জানান। এছাড়া তিনি বারসিক’র প্রতি কৃতজ্ঞ উপকরণ ও পরামর্শ প্রদানের জন্য। পাঠাগারটির জন্য বারসিক বিভিন্ন ধরণের ১৫০টি বই দিয়েছে। এমদাদ হোসেন খান ও সুবাস রঞ্জন দত্ত দিয়েছেন তাদের লেখা প্রত্যেকটি বইয়ের কপি। এছাড়াও তার দুই ছেলেও বিভিন্ন সময়ে বই সংগ্রহ করে দিয়েছেন। জন উন্নয়ন পাঠাগার নিজ পরিবার ও সমাজের উন্নয়নে বেশ অবদান রেখে চলেছে। নিজের ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিরা পাঠাগারে পড়তে আসা লোকদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়াশুনায় আগ্রহী হচ্ছে। তারা সময় পেলেই বিভিন্ন বই পড়ে সময় কাটায়।
এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রখ্যাত ব্যক্তি ও উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাগণ পাঠাগারটি পরিদর্শন করেছেন তাদের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এগ্রিকালচার পলিসি সাপোর্ট ইউনিট (আপসু) এর যুগ্ন সচিব (গবেষণা পরিচালক), কবি নির্মলেন্দু গুণ, মিজারিওর জার্মান এর এশিয়া ডেস্কের সমন্বয়ক ও বিভিন্ন লেখক উল্লেখযোগ্য। জনপাঠাগারটি পরিদর্শন করে প্রতিবেশী একই ইউনিয়নের দু’টি গ্রামের (উত্তর বিশিউড়া ও দড়িজাগি) লোকেরা ‘আব্দুল হামিদ খান স্মৃতি পাঠাগার’ নামে পাঠাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। পাঠাগার দু’টি গড়ে তোলার জন্য তারা আব্দুর রহমান‘র সহযোগিতা নিচ্ছেন। উদ্যোগক্তা আব্দুর রহমান মনে করেন, পাঠাগারটি প্রসারের জন্য বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং এই আয়োজনে এলাকার সকল শ্রেণীর মানুষকে পাঠাগার সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, এনজিও, সাধারণ জনগোষ্ঠী, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন প্রকাশনা বা লিখিত তথ্য দিয়ে, উপকরণ ও পরামর্শ দিয়ে পাঠাগার সম্প্রসারণে সহযোগিতা করতে পারেন।
দ্বন্দ্ব নিরসনে পাঠাগার
পাঠাগারটি সমাজের সকল মানুষকে একই মানসিকতায় একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। সকল বিবাদ ভূলে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের মানুষের মধ্যে শান্তি ও সংহতি স্থাপনে এই পাঠাগারের অবদান উল্লেখযোগ্য। আব্দুর রহমান জানান, এলাকার দু’টি গ্রাম রাজেন্দ্রপুর ও চল্লিশা গ্রামবাসীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। গ্রামের কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে অন্য গ্রামের কোন লোক অংশগ্রহণ করত না। দ্বন্দ্বের ফলে সন্মিলিতভাবে এলাকায় বা বাজারে কোন অনুষ্ঠান করা হতো না। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ফলাও করে প্রচারণা ও অনুষ্ঠান আয়োজন করে পাঠাগারটি উদ্বোধন করা হয় এবং নামকরণ করা হয় জন উন্নয়ন পাঠাগার। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষ সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে পাঠাগারটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সকল দ্বন্দ্ব ভুলে বিবাদমান দু’টি গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে গ্রামীণ খেলাধুলা প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিবাদমান দু’টি গ্রামের দ্বন্দ্ব নিরসন হয়। বর্তমানে সকল গ্রামের মানুষ এই পাঠাগারটিতে এসে বিভিন্ন বিষয়ে সহভাগিতার মাধ্যমে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। পাঠাগারটি হওয়ায় এলাকার কিশোর-কিশোরী, যুব সমাজ ও প্রবীণরা বিকাল থেকে রাত্রি অবধি পাঠাগারটিতে শিক্ষা ও সচেতনতামূলক আড্ডা দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে একে অপরের সাথে তথ্য বিনিময় ও সহভাগিতা করতে পারছেন। এর ফলে এলাকাবাসীদের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় হচ্ছে।
আব্দুর রহমান’র বলেন,“যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন নিজে এই পাঠাগারটি চালিয়ে যাবো। আমার অবর্তমানে পাঠাগারটি এলাকার লোকেরা পরিচালনা করবেন”। তিনি স্বপ্ন দেখেন, পাঠাগারটির আয়তন বৃদ্ধি হবে। উন্নত প্রযুক্তির আওতায় আসবে। যাতে এলাকার নবীণ প্রজন্ম প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। এর মাধ্যমে এলাকার প্রবীণ ও নবীণ প্রজন্মের মধ্যে সুসম্পর্ক, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও জ্ঞানের আদান প্রদানের সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এলাকায় নারী-পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোন ভেদাভেদ ও বৈষম্য থাকবে না। জনপাঠাগারটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে তৈরি হবে এবং একই স্থানে কৃষক পাঠশালা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চলবে। জন উন্নয়ন পাঠাগারটির আদলে বিভিন্ন গ্রামেও পাঠাগার চালু করে জ্ঞানের ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার গড়ে তোলা যাতে সকলের প্রবেশাধীকার সুনিশ্চিত হবে।
কৃষি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আব্দুর রহমানের বিচরণ
আব্দুর রহমান একজন বিদ্যানুরাগীও। এলাকার শিশুদের শিক্ষার কথা চিন্তা করে তিনি বাজারে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এলাকার বন্ধু-বান্ধব ও ছেলের সাথে আলোচনা করে বাজারে নিজের জমিতে ২০০৩ সালে “শাপলা বিদ্যানিকেতন” নামে একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র মো. আজাহারুল ইসলাম (চল্লিশা হাই স্কুলের লাইব্রেরিয়ান) ও পুত্রবধু কিন্ডার গার্টেন স্কুলটি পরিচালনা করছেন। বর্তমানে প্রায় ১৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে স্কুলটিতে। শিশু শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এই কিন্ডার গার্টেনে পাঠদান করা হয়। কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজসেবায় আব্দুর রহমান অবদান রাখার চেষ্টা করেন। এলাকার ছেলে-মেয়ে, কৃষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষদের নানাভাবে তিনি পরামর্শ দেন।
প্রকৃতিপ্রেমিক আব্দুর রহমান
আব্দুর রহমান একজন প্রকৃতিপ্রেমিক। কর্মদক্ষতার গুণে জীবদ্দশায় তিনি ৪০ কাঠা জমির মালিক হয়েছেন এবং জমিতে সারাবছর বিভিন্ন মৌসুমী সবজি, ধান, মাছ, ফল চাষ করেন, রোপণ করেন বিভিন্ন বৃক্ষও। কৃষি কাজ, বৃক্ষ রোপণ, বই পড়া, নতুন কিছু জানা ও শিক্ষামূলক আড্ডা দেয়া তার নেশা। রেলওয়ের জমি (রেল লাইনের ধার দিয়ে) লিজ নিয়ে সেখানে তিনি বিভিন্ন জাতের (কাঁঠাল, সুপারি, বেল, হরিতকি, আম, জলপাই, চালতা, বকুল ইত্যাদি) প্রায় ১৫০টি বৃক্ষ রোপণ করেছেন। বিভিন্ন এলাকার মানুষের সাথে তিনি এসব গাছের ফল ভাগ করে ভোগ করছেন। লিজ নেয়া জমিতে রেল লাইনের পাশ দিয়ে জনসাধারণের বাজারে ঢোকার ও চলাচলের সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করেছেন। আব্দুর রহমান গবাদী পশু-পাখিও (গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, কোয়েল পাখি) পালন করেন। বোবা ও নিরীহ প্রাণীদের প্রতি তার অগাধ প্রেম ও ভালোবাসা তাকে গবাদি পশু-পাখি পালনে উৎসাহিত করে। এসব বোবা প্রাণীদের সাথে তার বেশ সখ্যতা, তার উপস্থিতি টের পেলেই তারা আওয়াজ করে তাকে জানান দেয়।
আব্দুর রহমানের ভালোলাগা ও শখ
খেলাধুলা ও বই পড়ার পাশাপাশি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলা বা সময়ের কাজ সময়ে করা ছিল আব্দুর রহমান’র ভালো লাগা। তার মতে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যারা টিকতে পারে তারাই জীবনে সফল হয়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন বলেই তিনি আজ সফল হয়েছেন। বইপড়া ও মাছ ধরা তার প্রিয় শখ। সময় পেলেই তিনি বই পড়তেন ও মাছ শিকারে যেতেন। মাছ শিকারের সময় সাথে নিতেন বিভিন্ন ধরণের বই। তিনি যেসব লেখকের লেখা বই পড়তে ভালবাসতেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলো ড. লুৎফর রহমানের লেখা বই। বর্তমান পড়ন্ত বয়সকে (প্রবীণ) তিনি মনে করেন বোনাস সময়। তাই তিনি এই সময়টা শিশু-কিশোর, যুব ও সম বয়সীদের সাথে আড্ডা দিয়ে, বই ও পত্রিকা পড়ে, আনন্দ করে এবং অন্যদের সাথে পরামর্শ দিয়ে ও অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করে উপভোগ করেন এই সময়টাকে। তিনি বলেন,“আল্লাহ্র রহমতে আমার এখন কোন অভাব নেই। আমি বর্তমানে সকলের কমন দাদা। সকলেই আমাকে দাদা বলে ডাকেন, যা আমার খুবই ভালো লাগে এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই।”