বন্ধুর বাঁধন একতা ছাত্র সংঘ: একটি আলোকিত আখ্যান
নেত্রকোনা থেকে আওলাদ হোসেন রনি
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’ নামের এক কাল্পনিক আখ্যান। এ আখ্যান আমাদেরকে জানতে উৎসাহী করে সেই ‘কয়েকজন যুবক’ সম্পর্কে। কিন্তু বাস্তব, কখনো কখনো হার মানায় কল্পনার গল্পকেও। স্পর্ধিত তারুণ্য সারাদুনিয়া এরকম দুর্দান্ত সব গৌরবগাঁথা তৈরি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। কাল্পনিক নয়, চাঁদের আলোতে ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুর উপজেলার মাওহা গ্রামের কয়েকজন যুবক মিলে তৈরি করেছেন এমনই এক বাস্তবিক আখ্যান। সে আখ্যান তরুণ প্রজন্ম ও তারুণ্য সম্পর্কে আমাদেরকে ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করে। কারণ গল্পটা, একটু অন্যরকম। সে আখ্যান পাঠের জন্য আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে একটু পিছনে, ২০১৩ সালে।
২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, আকাবাঁকা মেঠোপথ, সারে সারে সাজানো বাড়িঘর, দূর থেকে দেখলে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মতোই একটি গ্রাম মাওহা। ‘হাজার বছর ধরে’ মাওহা গ্রামের বাসিন্দারা যাপন করছেন আর দশটা গ্রামের মতোই অভ্যস্ত জীবন। এখানে অভাব আছে, দুঃখ আছে, আছে গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিক বাঁধা-বিপত্তি, আছে এই বাঁধা জয়ের অস্বাভাবিক গল্পও। এই মাওহা গ্রামেরই উচ্চ মাধ্যমিক পড়–য়া কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে তাদের সহজাত দায়বদ্ধতা থেকেই গড়ে তুলেন ‘বন্ধুর বাঁধন একতা ছাত্র সংঘ’।
‘জন্মদাতার প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব, জন্মভূমির প্রতিও আমাদের দায়িত্ব একইরকম’। এই আপ্তবাক্যটিকে তারা ধারণ করেন মনে ও মগজে। সে বছর শীতে, শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত নেন কম্বল বিতরণের। সাধ অনেক, সাধ্য সীমিত। কম্বল বিতরণের অর্থ সংগ্রহ তাদের সে সাধ পূরণের সাধ্যকে পাহাড় সমান কঠিন করে তুলে। কিন্তু তাতেও নিতান্ত কৈশোর পেরোনো সেই তরুণেরা একটুও বিচলিত হননি। সবাই মিলে রাতে; চাঁদের আলোতে টাকার বিনিময়ে ধান কাটার সিদ্ধান্ত নেন। এই অঞ্চলের ভাষায় যাকে বলে ‘কামলা খাটা’। চাঁদ যখন ঠিক মাঝ আকাশে, সেই তরুণদের যখন ক্লাসের পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে যাবার কথা, তখন তারা কাস্তে হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ধান কাটতে। গ্রামের মানুষেরা অবাক হন তাঁদের প্রচেষ্টা দেখে। ৪৬ কাঠা জমিনের ধান কাটেন তারা। ধান কাটার অর্থ সংগ্রহ করে চলে যান ময়মনসিংহ শহরে। শহর থেকে কম্বল কিনে মাথায় করে নিয়ে গ্রামে ফিরেন। পরদিন গ্রামের সবাইকে নিয়ে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করেন তাঁরা। সে তাঁদের প্রথম জয়, চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। মনে তৃপ্তি, আত্মবিশ্বাস। প্রথম তাঁরা বুঝতে শিখলেন মানুষের প্রতি কর্তব্য পালনের ইচ্ছা সৎ থাকলে কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তাঁদের সেদিনের সেই আনন্দ নতুন নতুন কাজের পথ তৈরি করে। তৈরি হয় নতুন নতুন গল্প। ২০১৫, ২০১৬, ২০১৮ সালেও তাঁরা একইভাবে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করেন।
তাঁদের এই কাজে এলাকাবাসীও তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাঁদের কাজ কিছুটা সহজ হয়। ঋতু পরিবর্তনের বৈরি ফলাফল তাঁদেরকেও বিচলিত করে। সংগঠনের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন বৃক্ষ রোপণের। ২০১৩, ২০১৪ সালে তাঁরা ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের হাতে বৃক্ষরোপণ করেন। মাওহা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫০০ গাছের চারা রোপণ করেন তাঁরা। গ্রামের রাস্তাটির বেহাল দশা দেখে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন রাস্তা সংস্কারের। ভাবনামতো রাস্তাও সংস্কার করেন তাঁরা। মাওহা গ্রামের যে সমস্ত শিক্ষার্থী বৈরি পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে তাঁদের শিক্ষাজীবন চালিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুর বাঁধন একতা ছাত্র সংঘ তাঁদেরও পাশে দাঁড়ায়। আয়োজন করে কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনার।
২৫ শে মার্চ প্রথম গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে তাঁরা আয়োজন করেন প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনীর। ২০১৭ সালের দেশব্যাপী ভয়াবহ বন্যার সময় তাঁরা পাশে দাঁড়ান বন্যার্তদের। পরের জমিতে ধান রোপণের টাকা দিয়ে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেন বন্যার্তদের মাঝে। এবার ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তাঁরা আয়োজন করছেন কৃষক, শিক্ষার্থী এবং সাহিত্যিক সংবর্ধনার।
এভাবেই দুর্দান্ত সব কাজের মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশের কাছে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে ‘বন্ধুর বাঁধন একতা ছাত্র সংঘ’। একটি মহৎ আখ্যান লিখে চলেছেন তাঁরা। তৈরি করেছেন এমন এক গল্পের, যে গল্পে মানুষে মানুষে বন্ধনকে করে দৃঢ়। একটি মহৎ, সুন্দর, সমৃদ্ধ সমাজ বিণির্মাণের প্রশস্ত পথ নির্মাণে তাঁদের এই ভূমিকাকে আমরা জানাই অভিবাদন। আমাদের বিশ্বাস আগামী প্রজন্মের নায়কদের কাছে এমন গল্পের পটভূমি রয়েছে বিস্তর। আমরা তার সফল বাস্তবায়ন চাই।