সুস্থ থাকুক প্রাণ, সজীব হোক প্রকৃতি
নাটোর থেকে অমিত সরকার।।
কলেজের শিক্ষক উৎপল সরকার তার টিউশন রুমে শিক্ষার্থীদের নাস্তার জন্য বাজার থেকে কিছু ফল কিনেছিলেন। ফলের ভেতর থেকে কিছু আঙ্গুর বেঁচে যাওয়ায় ঐ রুমেরই এক কোণে রাখা ছিল। সেদিন আমি আর স্যার হঠাৎ টিউশন রুমে একটি কাজে যাওয়ার পর আঙ্গুরগুলো নজরে আসে। প্রায় ১৭ দিন পরও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেলো আঙ্গুরগুলো। স্যার বললেন, এগুলো ম্যাজিক ফল; কোনদিনও পঁচবেনা। স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন জাগলো, এই ফল তবে মানুষের পেটে গিয়ে পঁচবেতো?
রাজশাহী কলেজের ছাত্রী তন্নি সরকার আমারই বাড়ির সদস্য পাশাপাশি ফেসবুক ফ্রেন্ড। বছর দুয়েক আগের ঘটনা- হোস্টেলে থেকে পড়ার সময় বাজার থেকে কিছু টমেটো কিনেছিলেন। তার মধ্যে থেকে একটি টমেটো পরীক্ষা করার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। একদিন দেখি ফেসবুকে ছবিসহ পোষ্ট দিয়েছে, ‘টমেটোর অক্ষত অবস্থায় ১ মাসপূর্তী উপলক্ষে জন্মদিন পালন করবে’।
এলাকায় ঘোরাঘুরি ও কৃষকদের সাথে গল্পের মধ্যে দিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ধান চাষ করতে গড়ে তিনবার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। রাসায়নিক সার এর পরিমাণ নাকি জমি ভেদে ভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ হয়। এতে করে তাদের মতে উৎপাদন বাড়লেও লাভ নাকি হয় না। তাহলে প্রশ্ন কেনো এত রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার? তার উত্তরও পাওয়া যায় কৃষকদের কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ- সার বিষ ছাড়া কোন ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কিন্তু এর ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় দেশে খাবারের বিষক্রিয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল, রেস্টুরেন্ট বা নামিদামি ব্রান্ডের পণ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। প্রতিদিন যেসব খাদ্য নিজেরা খাচ্ছি ও সন্তানের মুখে তুলে দিচ্ছি, সেগুলোর অধিকাংশ পণ্যই ভেজাল মিশ্রিত। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের অবৈজ্ঞানিক ও হাতুড়ে প্রক্রিয়া সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি যখন জনকল্যাণকর ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে ঠিক একই সময় আমাদের দেশে এই জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা পর্যায়ক্রমে নীরব ঘাতকের মত আমাদের গলা চেপে ধরছে। আমরা প্রতিনিয়ত যেসব খাবার গ্রহণ করি তার মধ্যে রয়েছে ভেজাল। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রক্রিয়াও এখন ব্যতিক্রমধর্মী। জমি থেকে ফসল তোলা থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রস্তুত ফ্যাক্টরিগুলোতেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল।
ভেজালেরও ধরণেও রয়েছে ভিন্নতা। যে খাদ্যে যে ধরণের ভেজাল মেশালে সহজে চোখে ধরা পড়ার কোনো সুযোগ নেই সেদিকেই নজর রাখে মেশানো হয় ভেজাল। মাছে ফরমালিনের খবর এখন সকলের জানা রয়েছে। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে দেয়া হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। ভেজাল খাদ্য থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগ থাকলেও তা কাঙ্খিত নয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ভোক্তা। খাদ্যশিল্পের এমন কোনো খাত পাওয়া যাবে না যা দূষণমুক্ত। কাঁচা সবজি ও ফলমূল থেকে শুরু করে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মাছ, মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দূষণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে নিত্যনতুন পদ্ধতিতে নতুন নতুন খাদ্য দূষণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
খাদ্যে ভেজাল বা দূষণ মানে খাদ্য উপাদানকে কৃত্রিমভাবে কোনো উপায়ে দূষিত করা; যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া খাদ্যে অপরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারও খাদ্য দূষণের অন্যতম কারণ। ফলমূল, সবজি, মাছ এ রকম খাদ্যদ্রব্য পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ফরমালিন মেশানো হয়। ফল দ্রুত পাকানোর জন্য মেশানো হয় কার্বাইড। এসব ভেজাল ও সার কীটনাশকযুক্ত খাবার খেয়ে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে নানা ধরনের জটিল রোগ। বর্তমানে আমাদের দেশে বিবাহিত দম্পতির বন্ধ্যাত্ব যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এর মূল কারণ ভেজাল খাদ্য আহার বলে দাবি করেছেন এলাকার প্রবীণ মানুষেরা।
দেশ যখন ডিজিটাল হচ্ছে, আধুনিকের ছোঁয়া যখন পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামে। তখন সরকারের উচিৎ উন্নত দেশের মত আমাদের দেশেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে জোরদার ভূমিকা গ্রহণ করা। সাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভেজাল বিরোধী আন্দোলন গড়ে না উঠলে খাবার খাওয়া আর বিষ খাওয়া সমান হবে।