করোনাকালীন কৃষি ও কৃষকের অধিকার
সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
বর্তমানে অদৃশ্য এক সংক্রমণে জিম্মি গোটা পৃথিবী। খালি চোখে দেখা যায় না এমন অতি সূক্ষ্ম একটি ভাইরাস যার নাম কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। বিশ্বের মানুষের জন্য এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেহনতি দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্ব ভোগ করছে। কাজে যেতে পারছেনা মানুষ। বিত্তবানরা হয়তো দু’তিন মাসের খাবার মজুদ করেও রেখেছেন। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের তিন বেলা খাবার যোগার করে বেচে থাকাই যেন তাদের জন্য খুব কষ্টকর। তাই নিম্ন আয়ের মানুষকে নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারি বেসরকারি ত্রাণ সহযোগিতার উপর। তাছাড়া করোনা প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে চলছে লকডাউন, কারফিউ কিংবা অন্যান্য বিধি-নিষেধ। বন্ধ রয়েছে কলকারখানা ও যানবাহনসহ সকল কর্মকাণ্ড।
গবেষকরা মনে করেন এইসব লকডাউন দীর্ঘস্থায়ী হলে করোনা পরবর্তী সময়ে সারা দুনিয়া একটি অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্যনিরাপত্তা হীনতায় পড়বে। এই সংকট বাংলাদেশও প্রভাব ফেলবে। তাহলে এই সংকট কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, বা কি হবে তার পরিকল্পনা। সরকার ও গবেষকরা মনে করেন এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কৃষিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদন ও কোন জায়গা খালি না রেখে পতিত জায়গার যথাযথ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে কৃষকে। যদিও কৃষক নিয়মিত কৃষি কাজ করছে। তবুও সে কি জানতে পারে কৃষিতে কি তার অধিকার? বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করতে নিয়মিত ভাবে কৃষকদের সচেতন করার জন্য গ্রাম, ইউনিয়ন উপজেলা, এবং জেলা পর্যাযে চার স্তরের প্লাটফর্ম তৈরি করে কৃষকদের সচেতন করছে। বিশ্বের সকল দেশের মানুষ রযেছে ঘরবন্দি কিন্তু ঘরে নেই কৃষক। নিজের মত করে যাচ্ছেন কৃষি কাজ।
করোনার ভয় কে সঙ্গী করে মাঠে কাজ করছেন চাষ করছেন বৈচিত্র্যময় ফসল। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয় কৃষককে। হাওরাঞ্চলে বাঁধ ভেঙে কৃষি ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়ে ধানসহ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে শ্রমিক সংকট, পর্যাপ্ত ফসল সংরক্ষানাগার, লাভজনকর মুল্য থেকে বঞ্চিত এসব আশঙ্কা মাথায় নিয়েই কৃষক ফসল উৎপাদন করেন। তাছাড়া অতীতে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকট দেখা দিয়েছে তা মোকাবেলায় কৃষি ও কৃষকই পালন করছে মূল ভুমিকা। তারপর কৃষক কি পেয়েছে তার স্বীকৃতি ও অধিকার? স্বাধীনতা পরবতী যুগে কৃষির আমুল পরিবর্তন ও আধুনিকিকরণ করে প্রনোদনা দেওয়া হলেও ভূমিহীন প্রান্তিক কৃষকগন সবসময়ই হযেছেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। কৃষকের উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রী মুল্য অনেক কম হওয়ায় ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বানকিনা গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার ক্ষুব্ধ হয়ে পাকা ধানেই পেট্রল ঢেলে আগুন দিলেন। সঠিক পর্যাপ্ত সংরক্ষনাগার না থাকায় আলু ও টমেটো রাস্তায় ফেলে আন্দোলন করে কৃষক। কৃষিপ্রধান দেশে এটা কি ভাবা যায়!
শুধু যে ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হন তাই নয়। পাট, সরিষা, ভুট্টা, আলু, শাকসবজি কোনো ফসলেরই ন্যায্যমূল্য পান না কৃষকরা। একশ্রেণির ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী নানা কৌশলে কৃষকদের সারাবছরই ঠকায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা চাষাবাদে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। অনেক সময় সরকারিভাবে ধান-চালের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কারণে শুধু কারসাজিতে কৃষক তার অধিকার হারাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সিংগাইর বলধারা ইউনিয়ন কৃষি উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করতে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকার ঘোষিত ১০৪০ টাকা মুল্যে ধান ক্রয় করতে হবে। সরকারি ভাবে ইউনিয়ন পর্যায় ধান ক্রয়কেন্দ্র খুলতে হবে। যাতে কৃষক সরাসরি সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেন। তা ছাড়া ধান উৎপাদনের জন্য সার-ওষুধসহ যেসব উপকরণ দরকার হয়, সেসব উপকরণের মূল্য কমাতে হবে”। মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি করম আলী মাষ্টার বলেন, “কৃষদেরকে খাদ্যযোদ্ধা বলা হলেও কৃষকদের জন্য কোন পেনশন চালু নেই। সাধারণত সবকিছুর জন্য ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থা থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফসলের জন্যও বিমার ব্যবস্থা আছে। এক বছর যদি ফসল নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কৃষক কীভাবে বাঁচবে, এটা তো আমাদের ভাবতে হবে। বড় বড় কারখানার জন্য যদি প্রণোদনা ব্যবস্থা থাকে, তাহলে অবশ্যই কৃষকের জন্য কেন নয়”। যদিও সরকার করোনার জন্য সরকার ঘোষিত ৫০০০ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনা ঋণ প্রস্তাব ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রনোদনা ব্যবস্থা আরো বাড়াতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাদের ক্ষতি হবে তাদের সরাসরি অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকের অধিকার রক্ষায় সরকারের আরো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।