খাদ্য পুষ্টিতে বাহারী বড়ি
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
ভোজন রসিক বাঙালির নানারকম খাবারের মধ্যে জনপ্রিয় একটি হল বড়ি। গাঁয়ের বধুরা আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করেন এ সকল বড়ি সমাহার। দেশের উপকুলীয় অঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশের অনেক পরিবারে দেখা যায় পারিবারিক পুষ্টি খাদ্য হিসেবে বাহারী বড়ির সমাহার। বিশেষ করে গ্রামের নারীরা লোকায়ত জ্ঞান প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এসকল বড়ি তৈরি করেন। শীতকালে গ্রামীণ ঐতিহ্যের বড় একটি অংশ হল এই বড়ি।
শীতকালে গ্রামের নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন এই বড়ি তৈরিতে। মাসকলাইয়ের ডালের আটা ও পাঁকা চাল কুমড়ো মিশিয়ে এ সুস্বাদু বড়ি তৈরি করা হয়। উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কয়েক মাস পূর্বে থেকে চাহিদা মত চাল কুমড়ো পাঁকানোর ব্যবস্থা করে থাকেন। নতুন মাসকলাই ও চালকুমড়া ঘরে আসার সাথে সাথে বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। মাসকলাই ডালকে পানিতে ৫/৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ভালোভাবে হাত দিয়ে চটের ছালায় ঘুষে ডালের খোসা ছড়ানো হয়, তারপর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হয়। শুকানো ডাল (জাতার দ্বারা) আটায় পরিণত করা হয় এবং খুব সকালে পাঁকা কুমড়োকে দুভাগ করে কেটে কুরানি দিয়ে চিকন করে নিয়ে কুমড়োর বিচি আলাদা করে নিতে হয়। ওই কলাইয়ের আটা ও কুরানো কুমড়ো একটি পাতিলে মিশিয়ে দীর্ঘ নাড়াচাড়া করতে হয়। মিশ্রণ ঠিকভাবে হয়েছে কি না তা দেখার মহিলারা মাঝে মাঝে বড়ির আকৃতি করে পানির পাত্রে ছেড়ে দিলে তা যদি ডুবে যায় তবে আরও ফেনাতে (নাড়াচাড়া করতে) হয়, আংশিক ভাসলে বড়ি তৈরি উপযোগী হয়েছে বলে তারা মনে করেন। এই বড়ি রোদে ভালোমত শুকিয়ে রাকা হয় যা কিনা প্রায় ২ বছর সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
উপকূলীয় শ্যামনগরের তালবাড়ীয় গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ময়না রানী, আভা রানী, কল্পনা রানী ও সুনিতা রানী মনের মাধুরী মিশিয়ে বড়ি তৈরি করছেন। তারা বলেন, “বড়ি তৈরি এটা আমাদের একটি ঐতিহ্য। প্রতিবছর শীতকালে আমরা এই বড়ি তৈরি করি। সব ধরনের মাছ ও তরকারীর সাথে এটা রান্না করে খাওয়া যায়।”
মাসকলাই ডালের সাথে চাল কুমড়া ছাড়াও পাতাকপি, ওলকপি, বীটকপি, বেগুন, আলু, মূলা, কচু, পেপে প্রভৃতির মিশ্রণেও এই বড়ি তৈরি করেন উপকূলীয় অনেক নারীরা। গ্রামীণ নারীরা লোকায়ত পদ্ধতিতে নিরব নিভৃত্বে পারিবারিকভাবে জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে বড়ি তৈরি ও সংরক্ষণ করে চলেছেন। সময়ের পরিক্রমায় নিজেদের পরিবারের খাওয়ার জন্যই নয় বর্তমানে বাজারে চাহিদা থাকায় ব্যবসা হিসেবে বড়ি তৈরি করে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব।
বড়ির পুষ্টি গুণ অনেক বেশি, পেটের জন্য বেশ উপকারী, রুচি সম্মতভাবে খাওয়া যায়। নারীদের বড়ি তৈরির এই লোকায়ত জ্ঞানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে হবে।