পাখিমারা গ্রামে গলাছিলা জাতের দেশি মুরগি নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে পার্থ সারথী পাল
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের আইএফএম কৃষি নারী সংগঠনের জোসনা খাতুন স্থানীয় জাতের গলাছিলা মুরগির সংখ্যা বৃদ্ধি ও জাতের বিশুদ্ধতার জন্য প্রায়োগিক গবেষণা শুরু করেছেন।
আমাদের দেহের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে গৃহপালিত হাঁস-মুরগি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ছিল ১.৬০% এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.৩১%। আর মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১৪.৩১%। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদন বিগত সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মাংস, দুধ ও ডিমের জনপ্রতি প্রাপ্যতা বেড়ে যথাক্রমে ১২১ গ্রাম/দিন, ১৫৭ মি.লি/দিন ও ৯২টি/বছরে উন্নীত হয়েছে যা দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরিসংখ্যানগত হিসাব-নিকাশে ক্রম উন্নয়ন পরিলক্ষিত হলেও গ্রামীণ এলাকার বাস্তবতা ভিন্ন।এখনও অনেক প্রান্তিক গ্রামীণ পরিবার মাসেও একবার মাংসের স্বাদ নিতে পারেন না।
বিগত মার্চ-এপ্রিল, ২০১৭ সময়ে নেত্রকোণা, মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও রাজশাহী এই চারটি জেলার বারসিক কর্মএলাকায় পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশীয় জাতের প্রাণিসম্পদ প্রায় বিলুপ্তির মুখে। যেসব গ্রামে গবাদি প্রাণি তুলামূলক বেশি প্রতিপালন করা হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্বাচিত এই ধরনের ২০টি গ্রামে পরিচালিত এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেই সব গ্রামে শুধুমাত্র এক ধরনের দেশীয় জাতের গরু, দুই ধরনের ছাগল, ছয় ধরনের মুরগি আর দুই ধরনের হাঁস পাওয়া গেছে। পাশাপাশি সমীক্ষায় গ্রামগুলোতে পাঁচ ধরনের দেশীয় জাতের কবুতর পাওয়া গেলেও শুকর, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া ও খরগোশ পাওয়া গেছে মাত্র এক ধরনের। আবার এটাও দেখা গেছে, জাতগুলো আবার অন্য জাতের সাথে সংমিশ্রণের ফলে বিশুদ্ধ জাত পাওয়াও বেশ কঠিন। গ্রামাঞ্চলে উন্মুক্ত ভাবে পালনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন জাতের মধ্য সংকরায়নের ফলে এটা হয়ে থাকে। তবে এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতায় জানা যায়, গলাছিলা জাতের মুরগির উৎপাদন কিছুটা বেশি, বেশি ডিম দেয় এদের মাংস বেশি এবং রোগ-ব্যাধিও তুলনামূলক কম। তাই গবেষণার জন্য এই জাতটিই প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা করা হয়।
গ্রামের মানুষ আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং পছন্দের বিবেচনায় দেশীয় জাতের প্রাণিসম্পদ পালনেই বেশি আগ্রহী। এর কারণ হিসাবে তারা বলেছেন, দেশীয় জাতগুলো এলাকার আবহাওয়া-জলবায়ুর সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে, রোগ-ব্যাধি কম হয়, সব ধরনের খাবার খায়। এমনকি চরেও খেতে পারে। আপাতদৃষ্টে উৎপাদন কম হলেও যেহেতু খাবার এবং পরিচর্যার জন্য খরচ কম হয় তাই এটাই তাদের জন্য লাভজনক বলে মনে হয়। গ্রামের অনেকে বাজার থেকে মুরগির বাচ্চা কিনেও পালন করেন। এ জাতগুলো মুরগি ডিমে তা দেয় না তাই প্রতিবারই নুতন বাচ্চা কিনতে হয় যেটা অনেকে পছন্দ করে না। দেশি জাতের মুরগির ডিম এবং মাংসের স্বাদ উন্নত জাতের থেকে অনেক ভালো এবং দামও তুলনামূলকভাবে দ্বিগুণেরও বেশি।
গলাছিলা দেশি জাতের মুরগি নিয়ে পরিচালিত এই প্রায়োগিক গবেষণাটি পাখিমারা গ্রামের জোসনা খাতুন’র আগ্রহের প্রেক্ষিতে জানুয়ারি, ২০১৮ সময় থেকে তার বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে। জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষায় ১২ ফুট বাই ৬ ফুট মাপের একটি ঘরের, চারদিকে বাঁশের বেড়ায় আবদ্ধ করে ১৫টি গলাছিলা মুরগি যা সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ২টি মোরগ রাখা হয়েছে। ঘরের মেঝেতে চুন দিয়ে তারপর দুই ইঞ্চি পুরু কাঠের গুড়া বিছিয়ে মোরগ-মুরগির খাবারের জন্য জলের পাত্র রাখা হয়েছে। লোকায়ত জ্ঞানে রোগ-ব্যাধি সংক্রমণ দমন করা হবে এবং সংগঠনের সদস্যরাই খাবার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের দায়িত্ব নিয়েছেন। বারসিক-স্টাফ সদস্য গবেষণা চলাকালীন দৈহিক ওজন, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ, রোগব্যাধি, ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন, ডিমে তা দেওয়ার সময়কাল ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করবেন যা পরবর্তীতে বিশ্লেষণ করা হবে।
গলাছিলা দেশীয় জাতটি স্থানীয় আবহাওয়া-জলবায়ুতে অভিযোজিত মুরগির একটি জাত। বিলুপ্তপ্রায় মুরগির এই জাতটি সংরক্ষণ ও স্থানীয় এলাকায় এর সংখ্যা বৃদ্ধিতে পাখিমারা গ্রামে পরিচালিত প্রায়োগিক এই গবেষণা কর্মটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি গবেষণা কাজে গ্রামীণ নারীর সম্পৃক্তকরণ ও তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে এই ধরনের উদ্যোগে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।