পরিবেশ দূষণের নতুন সংস্করণ
নেত্রকোেনা থেকে রনি খান
ঢেঁকি বাংলা সংস্কৃতির একটি নিজস্ব উপাদান। শব্দগত ভাবেও ‘ঢেঁকি’ একটি মূল বাংলা শব্দ। এ কারণেই ঢেঁকি মূলত বাংলা সংস্কৃতির নিজস্ব পরিচয়ের বাহন। শুধুমাত্র এই ঢেঁকিকে কেন্দ্র করেই প্রচলিত আছে হাজারো ‘গীত’। আধুনিক বাজার সভ্যতার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের আগে ঢেঁকিতে ধান ভানাকে কেন্দ্র করে মানুষে-মানুষে এক ধরনের প্রবল আন্তঃনির্ভরশীলতাও তৈরি হতো। ঢেঁকিতে ভানা ধানে পুষ্টিগুণ অটুট থাকতো বলেও অনেক প্রবীন মানুষ মনে করেন। বাঙ্গালীর যে একটি বিচিত্র পিঠা সম্ভার রয়েছে তার অনেক জাতের ধান শুধুমাত্র ঢেকিতেই কুঠতে হয়। ঢেঁকিকে কেন্দ্র করে তাই গীত, শিললুক, সীমাসসা, এমনকি হাল আমলের বাগধারাও তৈরি হয়েছে অনেক।
‘ক্রমবর্ধমান’ মানুষের চাহিদা মেটাতে ঢেঁকির প্রয়োজনীয়তা একসময় শেষ হয়। আসে চাউল কল। গ্রামীণ মানুষের জীবনে আসে স্বস্তি। সেই সাথে বাণিজ্যিক চাউল কলেরও শুভ সূচনা হয়! বাঙ্গালী দরিদ্রের জীবনে সংযোজন হয় এক নতুন মাত্রার। এক নতুন ধারার শ্রম জীবন শুরু হয় তাদের। এই সময় ব্যাক্তি মালিকানায় যেমন চাতাল কল তৈরি হয় তেমনি সমবায় ভিত্তিতেও বেশ কিছু চাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি এন.জি.ও.’র প্রতিষ্ঠাও হয়েছিলো এই সমবায় ভিত্তিক চাতাল কলের মধ্য দিয়েই।
পরবর্তীতে ‘আরো বর্ধিত’ চাহিদা মেটাবার জন্য নতুন সংস্করণ ঘটে ‘অটো রাইস’ মিলের। সম্প্রতি এই সমস্ত চাউল কল ছাপিয়ে নতুন সংস্করণ এসেছে ‘ড্রাইয়ার এন্ড শুটার’ মেশিনের। অভিনব এই মেশিনে ধান মাড়াইয়ের পর মিলে নিলেই হল, সেখানে ধান শুকানো, ওড়ানো, ভানা এমনকি ‘হাতের কোন স্পর্শ ছাড়াই’ বস্তাজাত হয়ে চলে আসবে দোকানে। দোকান থেকে ক্রেতার হাতে।
সরেজমিনে (নেত্রকোনার বিভিন্ন জায়গায়) দেখা যায় বিশাল আয়তনের এই কলগুলো স্থাপন করা হয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তার পাশে এবং যার সাথেরি রয়েছে আবাদী জমি। বিশাল এই কলে কাজ করে এক সাথে প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন প্রশিক্ষিত শ্রমিক। এই কল চলার ফলে মূলতঃ কিছু পরিবেশগত সমস্যা দেখা যায়। এমন একটি মিলের পাশ দিয়ে যাতায়ত করেন এমন একজন মোটর সাইকেল আরোহীস সাথে কথা বলে জানা গেছে এই রাস্তা দিয়ে গেলে মোটর সাইকেলের স্বাভাবিক গতির চেয়ে কম গতিতে যেতে হয়। তিনি আরো অভিযোগ করেন ‘যারা এই সমস্ত মিলের ছাড়পত্র দেয়, তারা এই পথে গেলে গাড়ির কাঁচ তুলে চলে যান, কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা এই ছাই খেয়ে খেয়েই যেতে হয়।‘ এই বিষয়ে পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে যায় এমন একাধিক মানুষের সাথে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। মিলের আশে পাশের বাড়ির মধ্যেও ছাই উড়ে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা হচ্ছে। আশপাশের ধানী জমির মধ্যে গিয়েও দেখা যায় ফসলি জমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে ছাইয়ে। এই বিশাল আয়তনের মেশিনটি চালু থাকার কারণে শব্দদূষণ একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐ এলাকার জন্য। আবার সেই দূষণের ফলে প্রতিবেশগত এক ধরণের বিপর্যয়ও সেখানে স্পষ্ট।
এই কলটিতে ধান সিদ্ধ করবার জন্য থাকে কয়েকটি ‘ড্রাম’। প্রত্যেকটি ড্রামে ১৫০ মণ করে ধান তোলা হয়। জানা গেছে, ধান সিদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত সবটুকো পানিই তোলা হয় ভূ-গর্ভ থেকে। ব্যাবহারের পর সেই পানি আবার ছেড়ে দেয়া হয় সেই আবাদী জমি গুলোতে। যা আসলে একধরণের বিষ তৈরি করে। যে কারখানাটি প্রকৃত অর্থে বলা হচ্ছে মঙ্গলের জন্য, দেখা গেছে জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই সমস্ত স্থাপনা মানুষের হিতের চেয়ে অহিতই করছে বেশি। তবুও মানুষের চেতনার দরোজায় এই বোধ কড়া নাড়ার আগেই সবচেয়ে পুরোনো বিতর্কটি মানুষের সামনে চলে আসে- অর্থনৈতিক যোগ্যতায় ক্ষমতার দৌড়। মানুষ চাইছে সরকার এ বিষয়ে আশু হস্তক্ষেপ করুক। কথা বলে জানা গেছে নেত্রকোনায় প্রায় বিশটি এমন কারখানা রয়েছে। যার ছাইয়ে প্রতিদিন কালো হচ্ছে আকাশ, ধোঁয়ায় বিষাক্ত বাতাস, জলের বিষে নীল উর্বর ভূমি। কর্তৃপক্ষ এর একটি সুনির্দিষ্ট সমাধান করবেন ভুক্তভোগী জনতার এমনটাই বিশ্বাস।