জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়! দায় কার?
মানিকগঞ্জ থেকে মো. জাকির হোসেন রাজু
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান সময়ের একটি বিশ্ব প্রাকৃতিক সমস্যা। কিন্তু প্রকৃতির লীলাভূমি খ্যাত আমাদের বাংলাদেশের জনমানুষের জীবন জীবিকা এবং সামাজিক-সংস্কৃতি যেহেতু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকৃতিকে ঘিরে আবর্তিত। সেকারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক সমস্যাগুলো আমাদের জন-জীবনেই প্রভাব ফেলে বেশি। উপস্থিত সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবটা টের পাওয়া যাচ্ছে বেশি। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, এক ঋতুর ওপর আরেক ঋতুর প্রভাব এবং ভয়াবহ বজ্রপাতসহ আরো অনেক প্রকৃতি সৃষ্ট সমস্যাগুলো আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি দেখা দিচ্ছে। সারা পৃথিবী আজ যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এর মুখোমুখি এর পেছনের কারণটা কি? আর দায়টাই বা কাদের বেশি?
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দুনিয়াব্যাপী বিপুল জনসংখ্যার চাপ জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে বড় একটি কারণ। পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন হচ্ছে নতুন নতুন বাসস্থান আর কর্মসংস্থানের। যার ফলে অবাধে ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি, ভরাট করা হচ্ছে নদী-নালা, খালবিল, ছোট-বড় হাজারো জলাশয় এবং কমে আসছে আবাদী জমির পরিমাণ। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
এক জরিপে দেখা গেছে, গত দুই দশকে পৃথিবীর নিরক্ষীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ ১৯০ কোটি হেক্টর থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোট হেক্টর এর মতো। প্রতিবছর বনাঞ্চলের পরিমাণ কমছে প্রায় এক শতাংশ হারে। বাংলাদেশে এই পরিমাণ প্রায় ২ শতাংশ।
অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা। তাই জমি থেকে আরো বেশি ফসল উৎপাদন বাড়াতে ক্রমে আরো বেশি করে ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক। এতে করে একদিকে যেমন জমির গুনাগুণ নষ্ট হচ্ছে অপরদিকে এই কীটনাশক এর বিষ বাতাসে মিশে বাতাসকে দূষিত করছে। আবার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে এসব বিষাক্ত দ্রব্য বিভিন্ন নদী-নালা হয়ে কোন না কোন জলাশয়ে এসে মিশে যাচ্ছে। বাতাস, মাটি আর পানির এসব দূষণের ফলে বাড়ছে নানা প্রকার রোগ-ব্যাধি। আর বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ আর প্রাণি। আর ক্রমেই প্রকৃতি হারাচ্ছে তার নিজস্ব স্বাভাবিকতা।
তবে জনসংখ্যার চাপ জলবায়ু পরিবর্তনের বড় একটি কারণ হলেও দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের দায় বেশি অংশেই পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর উপর বর্তায়। বিশেজ্ঞদের মতে, আঠার-উনিশ শতকে ইউরোপ-আমেরিকার শিল্প বিপ্লব এবং পরবর্তীকালে এর ব্যাপক প্রসার এবং শিল্প উন্নত দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উন্নতিই দ্রুত জলবায় পরিবর্তনের জন্য দায়ী। দেখা যায়, শিল্প উন্নত ধনী দেশগুলো প্রাকৃতিক সমস্যার সৃষ্টি করে আর তার ভুক্তভোগী হয় উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলো। কারণ বড় ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় ধনী দেশগুলোর তুলনায় তাদের সক্ষমতা একবারেই নগন্য। যেমন মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশ। অথচ তারা পৃথিবীর মোট খনিজ জ্বালানির ৪ ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করে থাকে। আর পৃথিবীর সব কার্বন ডাই অক্সাইড এর ২২ শতাংশ মার্কিনিরাই সৃষ্টি করে।
দুনিয়াজুড়ে যত শিল্প কারখানা তার বেশিরভাগেরই অবস্থান নদী-নালা বা কোন না কোন জলাশয়ের নিকট। এসব শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য একদিকে যেমন পানিতে মিশে ধ্বংস করে দিচ্ছে বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদ আর মৎস্য সম্পদ, অন্যদিকে এসব কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে মিশে দূষিত করছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল। কলকারখানা থেকে নির্গত এসব বিষাক্ত ধোঁয়া আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর তাপমত্রা যে ক্রমেই উর্দ্ধমুখি হচ্ছে তা আজ সুস্পষ্ট।
বায়ুমন্ডলে কার্বণ-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রায় ২০০ শত বছর আগে, অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বে শিল্প বিপ্লবের শুরুতে এর
হার ছিল প্রতি লক্ষ ভাগে মোটামুটি ২৮০ ভাগের মতো, ১৯৭২ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি লক্ষ ভাগে ৩২৭ ভাগের মতো। ২০১৬ সালে অর্থাৎ বর্তমান সময়ে এসে এই হার প্রতি লক্ষ ভাগে ৩৮৫ ভাগের কাছাকাছি।
সারা পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে। তার মধ্যে নিকটবর্তী ২ দশকেই হারিয়ে গেছে প্রায় ১০ লক্ষ প্রজাতি। ৭০ এর দশকে এসব প্রজাতি ধ্বংসের হার ছিল প্রতিবছরে প্রায় ৩০ হাজারের মতো, ৯০ এর দশকে এর হার বেড়ে দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৫০ হাজারের মতো। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে প্রায় ৬০ হাজারের উপরে।
শিল্প উন্নত ধনী দেশগুলোর জনসংখ্যা সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র এক পঞ্চমাংশ। অথচ তারা ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি বাণিজ্যিক জ্বালানি। আর পৃথিবীর মোট কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ৭৮ শতাংশ এবং মোট শিল্প বর্জ্যের ৬৮ শতাংশ এরাই উৎপন্ন করে থাকে।
কাজেই বিভিন্ন জরিপের ফল এবং নানা প্রকার গবেষণার তথ্য অনুযায়ী আজ স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, বিশ্ব প্রকৃতির যে আজ চরম সংকটাপন্ন অবস্থা তার দায় বেশি অংশেই শিল্প উন্নত ধনী দেশগুলোর উপর বর্তায়।