জহুরা বেগমের জীবন সংগ্রামের গল্প
সাতক্ষীরা থেকে আব্দুল আলীম
পৃথিবীর সূচনা থেকেই নারী মানবসম্পদ উন্নয়নসহ সমাজ ও পারিবারিক কাজের সাথে সরাসরি জড়িত। কৃষির নানাধরনের কর্মকান্ড, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবজি ও ফসল উৎপাদন, সামাজিক বনায়ন প্রভৃতি কাজে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। পরিবার ও সমাজ সংস্কৃতির উন্নয়নে নারীরা রাখছে অসামান্য অবদান।
জহুরা বেগম (৪৯) একজন উদ্যোগী ও আগ্রহী নারী। নিজের সাহস ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে বুঝিয়েছেন। আমরা নারী আমরা পারি। অদম্য সাহসী জহুরা বেগম সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মীরগাং গ্রামে মোহাম্মদ আলী মীর ও মোমেনা বেগমের অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ওই পরিবারে ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্ম নেন জহুরা বেগম। জহুরা বেগম অভাব অনটনের মধ্যে দিন দিন বড় হতে থাকে। পিতা মোহাম্মদ আলী মীর ৭টি সন্তানের খরচ যোগাতে বড্ড হিমশিম খেয়ে যেত, কখনো ২ বেলা কখনো এক বেলা খেয়ে দিন খাটতো ৬ ভাইবোনের, এত অভাবের পরও ওই পরিবারে পরপর আরো ২টি সন্তান জন্ম নেয় অর্থাৎ মোহাম্মদ আলী মীরের এখন ৯ সন্তান যার মধ্যে জহুরা বেগম ৭ম। অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও আগ্রহ থাকা সত্বেও অভাবের কারণে ৩য় শ্রেণীর চৌকাঠ পার হতে পারিনি। শুরু হয় জীবনযুদ্ধ, নেটের জাল নিয়ে নদীতে দিনে ২ বার মাছ ধরা শুরু হয়, প্রতিদিনের আয় করতে হয় নিজের এবং ২০/৩০ টাকা প্রতিদিন তুলে দিতে হয় বাবার হাতে। মেয়ে হয়েও পরিবারের কিছুটা দায়িত্ব নেন তিনি। দেখতে দেখতে বয়স যখন ১৫তে দাড়াল তখন পরিবারের সম্মতিতে যশোরের ই¯্রাফিলের সাথে তার বিবাহ হয়। দীর্ঘ ১৯ বছর সংসার করার পর বিভিন্ন নেশায় আসক্ত স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুইটি ছেলে রেখে বাবার বাড়িতে চলে আসেন।
শুরু হয় নতুন জীবন। নদিতে জাল টানাা আর অন্যের জমিতে দিনমজুরি দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে আয় রোজগারের চেষ্টা করতে থাকেন। একটু সুখের আশায় আবার ও ঘর বাধেন, কিন্তু জানতেন না যার সাথে বিবাহ হচ্ছে তার আগের পরিবার আছে। কিছুদিন পর একটি ছেলে রেখে তিনিও আগের সংসারে ফিরে যান। একটি ছেলে নিয়ে আবারও একা হয়ে যান জহুরা বেগম, চলতে থাকে জীবনযুদ্ধ।
২০২১ এর অক্টোবর মাসের দিকে হঠাৎ একদিন বারসিক’র কর্মী আঃ আলিম জহুরা বেগমের বাড়িতে যান এবং কিছু তথ্য পূরণ করেন এবং কিছুদিন পর জহুরা বেগমকে একটি গ্রুপে আসতে বলেন এবং বলেন আপনি বারসিক’র পরিবেশ প্রকল্পের সদস্য হয়েছেন। প্রতি রবিবার এখানে সাপ্তাহিক সভা হবে। এভাবে মিটিং এ উপস্থিত হতে থাকেন জহুরা বেগম। কিছুদিন পর জহুরা বেগমের পরিবার উন্নয়নের জন্য একটি ব্যবসার কথা শোনেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করে একটি চায়ের দোকান করার প্রস্তাব করেন। তার চাহিদামত বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে তাকে বারো হাজার টাকার চায়ের দোকানের উপকরণ কিনে দেওয়া হয়। তিনি একজন নারী হয়েও এখন প্রতিনিয়ত চায়ের দোকানে চা বিক্রি করছেন। প্রতিদিন অনেক মানুষের সাথে মিশে তাদের চা খাওয়াচ্ছেন জহুরা বেগম এবং প্রতিদিন আয় করছেন ২০০-২৫০ টাকা।
তিনি মনে করছেন তার সুখের দিন শুরু হয়েছে। এভাবে তার অভাব নামের ভূতটা ঘাড় থেকে নামবে। তিনি খুব তাড়াতাড়ি সোনালী দিনের স্বপ্ন দেখছেন। এ প্রসঙ্গে জহুরা বেগম এর কাছে তার স্বপ্ন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার এই চায়ের দোকানের ব্যবসাটি দিন দিন বড় করে সেখান থেকে আয় বাড়িয়ে আগামীতে নিজের একটি পাকা ঘর করতে চাই।”
জহুরা বেগমের জীবনের গল্প পিছিয়ে পড়া অবহেলিত অনেক নারীকে সাহসী ও আগ্রহী করে তুলবে।