একজন শতবর্ষী হাজিরনের কথা
মানিকগঞ্জ থেকে ঋতু রবি দাস
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই- ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি-
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী
মানব জীবনটা রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতার মতই, শেষ বয়সে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের জীবন যাত্রার উদ্দেশ্য। বারসিক’র কাজের সাথে জড়িত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া হয় এবং বিভিন্ন লোকের সাথে পরিচয় হয়। মানিকগঞ্জ সদরের বড় সরুন্ডী আমার কর্ম এলাকা। সেখানেই পরিচয় হয় হাজিরন (১১০) নামের বৃদ্ধা নারীর সাথে।
হাজিরনরা ছিলেন তিন বোন এবং দুই ভাই। তাঁর বড় বোন পাতন এবং ছোট বোন যতন। মা বাবার মৃত্যুর তার বড় বোন পাতনই হাজিরনকে লালন-পালন করেন এবং বিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বড় ছেলে হয়েছিলো। তার পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। তার এক ছেলে অনেক আগেই মারা গেছে। ছেলের মারা যাওয়াটাকে মানতেই পারেননি তিনি। তাই আফসোস করে বললেন, ‘মরার কথা আমার কিন্তু আমার ছেলেটাই মারা গেল।’ তাঁর স্বামী কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানান, বড় ছেলে হওয়ার তিন বছর পরই তিনি মারা যান। তিনি এখন তাঁর ছেলেমেয়েদের সাথেই থাকেন বলে জানান।
তার ছেলেমেয়েরা একই জায়গায় থাকেন বলে তাঁর থাকা খাওয়ার সমস্যা হয় না। তিনি বলেন, ‘আমি সবার বাসায় খাই, যার আগে রান্না হয় তাগোর মধ্যেই খাই। প্রতিদিন গোসল করার সময়, যে বউয়ের কাজ থাকেনা সেই করিয়ে দেয়, আমার নাত বউও করিয়ে দেয়।’ তবে তিনি নিজের বাসন নিজেই পরিষ্কার করেন। তার বাসনগুলো চিকচিক করে। নিজের বিছানার কাঁথা চাদর নিজেই কাঁচেন। চোখে এখনও স্পষ্ট দেখেন। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক সুখে আছি, পুলারা ক্ষেতে চাষাবাস করে। তাই দিয়া সংসার চইলা যায়, আমাগোর অভাব নাই, আমাগো খাই খাই নাই।’
হাজিরন এত বয়সেও কোন ভাতা পান না। কারণ তাঁর কোন জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তবে বয়স্ক ভাতা পেলে ভালো হতো বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি বয়স্কভাতা পাইলে অনেক কিছু করতাম।’ এই বয়সেও তিনি এখনও কাজ করতে পারেন। তার বড় ছেলের স্ত্রী জানান, হাজিরন এখনও ভোর পাঁচটায় উঠেন। সম্পূর্ণ উঠান ঝাড়–ু দেন। দুই দিন পরপরই গোবর দিয়ে ঘর লেপেন। তিনি এখনও সূঁইয়ের ভিতর সুতা ভরে কাঁথা সেলাই করতে পারেন। হাজিরন বলেন, ‘যখন আমি বউ হয়ে আসি, কোন মুরুব্বিরা হেঁটে গেলে তাদের ছায়া পর্যন্ত আমি পারা দিতাম না। সবাই আমাকে খুব ¯েœহ এবং ভালোবাসত। আমি কোনদিন মানুষের ক্ষতি করি নাই, সবাইরে মাইনা চলছি, আল্লা আমারে দেখে। আমি সব সময় ঘর থিক্যা বাইর হইলেই মাটিরে সালাম করতাম, মাটির অনেক সইয্য।’
মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ তো সেইদিন হলো। তখন আমার বড় ছেলে অনেক বড় ছিল। তাকে নিয়ে যুদ্ধে আমার আর তোমার দাদার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে বেশির ভাগই লোকজনই অন্য ধর্মের ছিলো। তাদের সবাইকে আমরা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিতাম। কারণ পাকিস্তানিরা আমাদের কিছু বলত না! অনেক রাজাকাররা আমাদের কাছে জানতে চাইত যে, মানুষগুলো (অন্য ধর্মের) কই, আমি কইতাম যে জানিনা। তারা তাগো না পাইয়া চইলা যাইত।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাদের আমাগো বাড়ি থাকলে আমরা তাগোরে খাওয়াইতাম। যুদ্ধের আগে আমরা দেড় টাকা মণ ধান খাইসি আর চার পয়সা কইরা চাইল কেজি কইরা বেঁচত। আমাগোর অবস্থা ভালোই ছিল। তাই তাগোরে খাওয়াতে আমাগোর কষ্ট হয় নাই।’