আন্তঃনির্ভরশীলতাই আত্মনির্ভরশীলতা
সিলভানুস লামিন
আন্তঃনির্ভরশীলতা বনাম আত্মনির্ভরশীলতা
লেখার শিরোনামটি দেখে কারও মনে হতে পারে যে, এটি স্ববিরোধী। কেননা যে মানুষ বা প্রাণী আত্মনির্ভরশীল সে কীভাবেই আন্তঃনির্ভরশীল হবে বা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হবে? আন্তঃনির্ভরশীলতা হচ্ছে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়াকে বুঝায় অন্যদিকে আত্মনির্ভরশীলতা মানে নিজের ওপর নির্ভরশীলতা বুঝায়। সমাজ থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রতিটি মানুষই আত্মনির্ভরশীল হতে চায়। প্রতিটি অভিভাবকই তাদের সন্তানকে লেখাপড়া করান এবং সন্তানদেরকে এই মূলমন্ত্র দেন যে, তাদেরকে (সন্তানদের) আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। আমি নিজেও আমার সন্তানদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা বলেছি। তাহলে কীভাবেই বা বলতে পারি আন্তঃনির্ভরশীলতাই হচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতা? অর্থনীতি ও সমাজনীতির ভাষায় আত্মনির্ভরশীলতা হচ্ছে মানুষের সেই অবস্থান যেখানে সে অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেই নিজের অবস্থান তৈরি করেন, তার চাহিদা মেটান, যা খুশি তা ক্রয় করতে পারেন, ভ্রমণ করতে পারেন, চিন্তা করতে পারেন বা তার নিজের জীবিকা নির্ধারণ করতে পারেন। পৃথিবীতে সবচে’ সম্পদশালী মানুষের কথায় ধরা যাক! তাঁদেরকে আমরা আত্মনির্ভরশীল বা স্বনির্ভরশীল বলি। কারণ তাঁদের যে সম্পদ রয়েছে তা দিয়ে তারা যেকোন কিছু (আর্থিক মূল্য আছে) করতে পারেন। তারা অনেকের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করেন। ধরুন বাংলাদেশের কোন বিত্তশালী মানুষের কথায় বলি। তিনি অনেক সম্পদ ও সম্পত্তির মালিক। তিনি হয়তো অনেকের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন। এই বিত্তশালী মানুষ তো বলতেই পারেন তিনি কারও ওপর নির্ভরশীল নন! তিনি তাহলে আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ? অবশ্যই না!
কারণ প্রকৃতির ভাষায় সবাই যেমন আত্মনির্ভরশীল তেমনিভাবে আত্মঃনির্ভরশীলও। ওই বিত্তশালী মানুষ তো বলতেই পারেন তিনি ভাত খান না। তাই তিনি কৃষকের ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি হয়তো বার্গার খান। কিন্তু এই বার্গার যে উপাদান দিয়ে তৈরি (গম, সবজি) সেগুলো তো একজন কৃষকই উৎপাদন করেন! সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ওই বিত্তশালী মানুষের অনেক সম্পদ থাকতে পারে কিন্তু তিনিও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও একজন কৃষক, একজন জেলে, একজন মুচি, একজন দর্জিসহ অনেকের ওপর নির্ভরশীল। আবার তিনি তো পানি পান করেন, তিনি ফল, মূল খান, অসুস্থ হলে ওষুধপত্র খান (অনেক ওষুধের কাঁচামাল প্রকৃতি থেকে সংগ্রহীত) অক্সিজেন গ্রহণ করেই তো বেঁচে আছেন তাহলে তিনি প্রকৃতির ওপরও নির্ভরশীল। অন্যদিকে প্রকৃতির উদ্ভিদ বা গাছ বলতেই পারে সে নিজেই তার খাদ্য তৈরি করতে পারে বলে সে আত্মনির্ভরশীল। কিন্তু এই গাছ নিজের খাদ্য যে প্রক্রিয়ায় তৈরি করে (সালোক সংশ্লেষণ) সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য তো সূর্য্যরে আলো প্রয়োজন! শীতকালে সূর্য্যরে আলোর প্রকোপ কম বলে এ সময় অনেক উদ্ভিদের পাতা ঝরে যায়; অনেক উদ্ভিদ মারাও যায় এ সময়। অন্যদিকে বেড়ে ওঠার জন্য সেই উদ্ভিদের মাটি ও জল প্রয়োজন হয়! তাহলে এই উদ্ভিদ কোনভাবেই আত্মনির্ভশীল নয়; বরং আন্তঃনির্ভরশীল। অন্যদিকে প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান তথা প্রাণ ও অস্তিত্ব কখনও মাথা উচু করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে পারেনা যদি মাটি না থাকে। শুধু মাটি থাকলেও তো হবে না; পানি ও বায়ুর তো দরকার হয়। এভাবে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল না থেকে থাকতে পারে না। একে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতার সম্পর্ক সুদৃঢ় করার মধ্য দিয়েই গাছ হোক কিংবা মানুষ হোক তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। প্রকৃতিতে যত বেশি আদান-প্রদান হয় ততবেশি শক্তিশালী হয় প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের বন্ধন। তাই বলা যায়, আন্তঃনির্ভরশীলতাই একজন মানুষ, প্রকৃতির গাছপালা, জীবনজন্তুসহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলে।
আন্তঃনির্ভরশীলতাই বৈচিত্র্যকে বিকশিত করে
প্রকৃতির উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষ পরস্পরের ওপর তখন বেশি নির্ভরশীল হবে যখন প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য থাকবে সমৃদ্ধ। এই বৈচিত্র্যের বিভিন্ন উপাদানকে ঘিরে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক শক্তিশালী হয়। বিভিন্ন উদ্ভিদের ফল, ফুল আছে বলেই পাখিরা সেই উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসে। সেই ফুল ও ফল খেয়ে বেড়ে উঠে। সেই উদ্ভিদের ফল ও ফুল খেয়ে মলের মাধ্যমে তারা অন্য এলাকায় এসব উদ্ভিদের জন্ম দেয়; বৈচিত্র্যকে আরও বিকশিত করে। আবার বনের বিভিন্ন ছোট ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে বলেই পোকামাকড় থেকে শুরু করে বড় আকারের প্রাণীগুলো সেই সব ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংস্পর্শে আসে; খাদ্য হিসেবে যেমন সেগুলো গ্রহণ করে তেমনিভাবে সেগুলোকে লালন-পালন করে যাতে তাদের খাদ্যের কোন সমস্যা না হয়। মৌমাছি মধু সংগ্রহ করার জন্য বনের অনেকগুলো গাছে যায়, সেই গাছের ফুলের রস নিয়ে মধু তৈরি করে। মানুষ আবার সেই মধু সন্ধানে বনে যায় মৌমাছির চাক খোঁজার জন্য। এভাবে মৌমাছি, গাছ ও মানুষের মধ্যকার এক অলিখিত আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরি হয়। অন্যদিকে জেলে মাছ ধরার জন্য নদীতে যায়। এই মাছ ধরার উপকরণসমূহ (চিপ, চাই, মাছ রাখার জন্য মাটির পাত্র, বাঁশের ঝুড়িসহ আরও অনেক) আবার তাকে একজন বাঁশবেতের শিল্পী ও কুমারদের কাছে যেতে হয়। আবার এই কুমার ও বাঁশ বেতের শিল্পী মাছের জন্য জেলেদের কাছে যেতে হয়। এভাবে তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান সেটা খাদ্য হোক, ওষুদ হোক, ফল হোক পরস্পরের সাথে বিনিময় ও সহভাগিতা করার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। যেমন কৃষক ধানসহ বিভিন্ন ফসল পরস্পরের সাথে বিনিময় করেন ঠিক তেমনি তিনি নিজেও মাছ থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য অন্যান্য পেশাজীবীর ওপর নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরি করেন। আবার মানুষের বৈচিত্র্যময় জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আছে বলেই ভিন্ন ভিন্ন মানুষ তাদের কাছে ছুটে যান সেগুলো জানার জন্য। আইন সম্পর্কে জানার জন্য একজন মানুষ আইনজ্ঞের কাছে যান, জলবায়ু সম্পর্কে জানার জন্য জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, জেন্ডার সম্পর্কে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, চাষবাস সম্পর্কে কৃষক, কাপড়ের বুনন সম্পর্কে তাঁতীসহ নানান জ্ঞানের নানান মানুষের মধ্যকার আদান-প্রদান হয়। এভাবেই তো আন্তঃনির্ভরশীলতা সম্পর্ক তৈরি হয়। এভাবে একে একে যদি বিশ্লেষণে যাই তাহলে দেখতে পাবো আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ক প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যকার বৈচিত্র্যকে বিকশিত করতে যেমন ভূমিকা রাখে তেমনিভাবে বৈচিত্র্যগুলো মানুষের ও বিভিন্ন প্রাণের আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ককে সুর্দঢ় করে। তাই বৈচিত্র্য যত বেশি থাকবে মানুষহ অন্যান্য প্রাণের মধ্যকার আদান-প্রদানও ততবেশি হবে; তৈরি হবে আন্তঃনির্ভরশীলতার শক্তিশালী সম্পর্ক! বৈচিত্র্যকে বাদ দিয়ে আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ক যেমন কল্পনা করা যায় না তেমনিভাবে আন্তঃনির্ভরশীলতাকে বাদ দিয়ে বৈচিত্র্যকে বিকশিত করা সম্ভবপর নয়।
আন্তঃনির্ভরশীলতা সংঘাত ও সহিংসতা প্রশমন করে
বর্তমান বিশ্বে মানুষের মধ্যকার আদান-প্রদান ও বিনিময় করার সংস্কৃতি কমে গেছে। প্রকৃতিতে এবং মানুষের মননে ও চিন্তায় বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার কারণে এ আদান-প্রদান কমে যাচ্ছে। বর্তমানে মানুষ নিজেকে ছাড়া অন্য কারও কথা চিন্তা করে না। তার আশপাশের প্রকৃতি, প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান, অন্য সম্প্রদায়, লিঙ্গ, বর্ণ, বয়স ও ধর্মের মানুষের কথা ভাবতে চায় না। তাই তো নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য মানুষ প্রকৃতির যেমন বিভিন্ন প্রাণ ও অস্তিত্ব ধ্বংস করছে তেমনি তার মতো মানুষকেও হত্যা করতে পিছপা হয় না! এসব বৈচিত্র্যময় সম্পদ নষ্ট ও হত্যা করলে সেই মানুষকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হতে হয় তা নিয়ে তার মধ্যে ভাবনা নেই। এভাবে প্রকৃতিতে এবং মানুষের ব্যবহার, চিন্তা, জ্ঞান এবং মননে বৈচিত্র্য কমে গেছে। বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার কারণে আন্তঃনির্ভরশীলতাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। মানুষ এখন পরস্পরের সাথে খুব কম আদান-প্রদান করে। শহরের এলাকায় এই প্রবণতা আরও বেশি। শহরের এলাকার এই আত্মকেন্দ্রিকতার সংস্কৃতি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর হওয়ার কারণে তার মতো করে অন্য মানুষকে সময় দিতে পারে না; আদান প্রদান করে না। তাই তো দেখা যায়, একই ভবনে বাসবাসের পরও অনেকে পরস্পরকে চিনে না, জানে না; পরস্পরের সাথে আদান-প্রদান করা তো দুরের কথা! ফলশ্রুতিতে সহনশীলতা ও সৌহার্দ্য সম্পর্ক হ্রাস পেয়ে মানুষ ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে যাচ্ছে। সমাজে এভাবে সহিংসতা ও সংঘাত তৈরি হয়। অনেকের মতে, সমাজে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মতামত, মতাদর্শ, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, ভাষা, প্রথা, ধর্ম এবং মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা করা এবং স্বীকৃতি দেওয়ার প্রবণতা কমে যাওয়ায় সমাজে সংঘাত ও সহিংসতা বাড়ছে। মানুষের সমাজের ভেতরের এই সহিংসতা প্রকৃতিকেও ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসে মুখে। বেশি উৎপাদনের নেশায় রাসায়নিক দিয়ে মাটিকে হত্যা করা, জলাশয়, খাল, নদী দখল ও ভরাট করে ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে এসব প্রাকৃতিক উপাদানের স্বাভাবিক চিরতরে বিলীন করা, কলকারখানার ময়লা, বর্জ্য পানিতে নিক্ষেপ করে পানিকে হত্যা করা, খাদ্যের জন্য ব্যক্তিগত লাভ চরিতার্থ করার জন্য বন উজাড়, সেখানকার বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থলকে বিপন্ন করা ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষের অসহনশীলতা ও আগ্রাসী আচরণের কারণে সংঘতিত হয়েছে।
যে সমাজে আদান-প্রদান বেশি হয়, মিথস্ক্রিয়া হয় বেশি সে সমাজে সংঘাত ও সহিংস কম হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মেঘাটিলা নামে একটি খাসি আদিবাসী গ্রাম আছে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায়। সেই গ্রামের মানুষেরা প্রকৃতি থেকে বা অন্য কারও কাঠে যা কিছু পান সবার সাথে আদান-প্রদান করেন। বন থেকে কোন শাক কুড়িয়ে আনলে যেমন পরস্পরের সাথে বিনিমিয় করেন ঠিক তেমনি কোন নতুন বিষয় জানলে সেটাও সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যকার আদান-প্রদান ও আন্তঃর্নিরশীলতা থাকার কারণে পরস্পরের সাথে কদাচিৎ ঝগড়া করেন, কোন সামান্য বিষয় নিয়ে কখনও হানাহানি করেন না। এই গ্রামে সংঘাত বলতে কোন কিছু নেই; আছে সংহতি। কোন বাড়িতে বিয়ে অনুষ্ঠান হলে পুরো গ্রামের মানুষ সেই বিয়ের জন্য যাবতীয় করণীয় নিজের কাঁধে তুলে নেয়। কেউ মারা গেলে সবাই মিলে সৎকারের যাবতীয় কাজ করেন। এই গ্রামে তাই জমি দখল হয় না; কারও ফসল নষ্ট হয় না; কাউকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে না। বাংলাদেশে মেঘাটিলার মতো আরও অনেক গ্রাম বা এলাকা আছে যেখানে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা ও শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি চর্চিত হয়। এই গ্রামগুলোতে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতার মাত্রাও বেশি।
উপসংহার
মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে আন্তঃনির্ভরশীলতা সম্পর্ক যত বেশি হবে ততবেশি লাভবান হবে মানুষ নিজে। কারণ একমাত্র মানুষই প্রকৃতির সব ধরনের উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। আবার মানুষে মানুষে এই নির্ভরশীলতার মাত্রা তারতম্য রয়েছে। একজন কৃষকের আন্তঃনির্ভরশীলতার মাত্রা একজন ব্যবসায়ী বা সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তার চেয়ে কম। কারণ একজন কৃষক তার মতো করে জেলে, কামার, কুমার, দোকানদার, মুচি, দর্জির কাছে নির্ভর করতে হয়; বিভিন্ন জ্ঞান বা তথ্যপ্রযক্তির ওপর তার নির্ভরশীলতা খুব একটা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে একজন ব্যবসায়ী বা সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তাকে জীবন পরিচালনার জন্য সবক্ষেত্রেই বেশি নির্ভর করতে হয় অন্যের ওপর। খাদ্যের জন্য কৃষক, জেলে, পোশাকের জন্য দর্জি, তাঁতী, অফিসের কাজ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান, আইন, নীতিমালার সাথে সম্পর্কিত মানুষের ওপর তারা নির্ভরশীল। তবে মানুষে মানুষে মধ্যকার নির্ভরশীলতার মাত্রার ক্ষেত্রে তারতম্য থাকলেও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতাই কোন তারতম্য নেই। কেননা আলো, বায়ু, পানি, মাটি, আগুন ছাড়া কোন প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।
তাই বলা যায়, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বৈচিত্র্যের গুরুত্ব যদি মানুষ সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারে তাহলে মানুষ কখনও এগুলো ধ্বংস করবে না; নিজের খাদ্যনিরাপত্তা ও যোগান নিশ্চিত করার জন্য মানুষ কখনও অন্যান্য প্রাণের খাদ্যনিরাত্তাকে বিঘিœত করবে না। বেশি লাভের নেশায় রাসায়নিক ব্যবহার করবে না; মুনাফার জন্য প্রাণীর মোটাতাজাকরণ করবে না; নদীনালা, খাল বিল, জলাভূমি দখল ও ভরাট করবে না। মানুষ প্রতিটি প্রাণের প্রতি যতœবান ও শ্রদ্ধাশীল হবে। মানুষ সত্যিকার অর্থে যদি আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বৈচিত্র্যের গুরুত্ব উপলদ্ধি করতো তাহলে পৃথিবীতে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হতো না, বাংলাদেশের অনেক নদী ও বন বেঁচে যেতো, বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা কমে যেতো না (শকুন না থাকায় পশুসহ অন্যান্য পচনদ্রব্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণের হার কমে যাওয়ায় ব্যাকটেরিয়াভিত্তিক বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রার্দুভাব বেড়ে গেছে আক্রান্ত করছে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীকে), সুন্দরবনে বাঘ ((খাদ্যের জন্য বাঘকে লোকালয়ে এসে মানুষকে আক্রমণ করতো না) ও হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বেড়ে যেতো, বনে নানান রকম উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণ তাদের উপস্থিতি জানান দিতো। এরকমই অনেক প্রাণ ও অস্তিত্ব বেঁচে থাকতো। তবে এখনও সময় আছে প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও অস্তিত্বকে রক্ষা করার, তাদের মধ্যকার আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার। প্রতিটি মানুষই যদি তার স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রচেষ্টা চালায় তাহলে একদিন না একদিন প্রকৃতির মাঝে হারানো আন্তঃনির্ভরশীলতা আবার জেগে উঠবে, উদ্ভিদ, প্রাণীসহ অন্যান্য বৈচিত্র্যতাও বৃদ্ধি পাবে।