নগর জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের জন্য তহবিলের দাবি
রাজশাহী থেকে অমিত সরকার
বিশেষ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর জলবায়ু বিপদাপন্ন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং প্রতিনিয়তই বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে: যেমন-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধ্বস, নদী ভাঙ্গন এবং খরা। এই সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা ও পরিমাণ বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে হতাহতের পরিমাণ বৃদ্ধি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং দেশব্যাপী মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে তাদের আবাস ও ভূমি হারিয়ে স্থানচ্যুত হতে বাধ্য করে। এর কারণ হলো, কিছু আকস্মিক দুর্যোগ, যেমন: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙ্গন এবং দীর্ঘমেয়াদী দুর্যোগ, যেমন: ভূমিক্ষয়, সমুদ্রস্ফীতি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন ও খরার প্রাদুর্ভাব।
এসকল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা কারণে দেশের গ্রাম ও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে কাজের অভাব দেখা দেওয়াতে শহরবাসী হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। যাদের অধিকাংশেরই জায়গা হয়েছে দেশের নগরগুলোর বস্তিগুলোতে। যেখানেও নিরাপদ খাবার, পানি সংকটসহ নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছেন ঘর ছাড়া মানুষেরা। তাদেরকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। সেই কারণে এবার রাজশাহী নগরীর বহরমপুর রেল লাইনের ধার ঘেসে গড়ে উঠা বস্তিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত বহরমপুর সার্বিক উন্নয়ন সংগঠনের উদ্যাগে নগর জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের দাবি তুলেন।
সম্প্রতি নগরের বহরমপুর বস্তিতে বসবাসকারীরা বিভিন্ন ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়ি এ দাবি তুলে ধরেন। ২৫ বছর আগে গাইবান্ধা জেলা থেকে নদীভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারিয়ে মকলেছুর রহমান (৫০+) তার পরিবার মমতাজ বেগম (৪৫) কে সাথে নিয়ে রাজশাহীর বহরমপুর বস্তীতে বসবাস শুরু করেন। মমতাজ বেগম বলেন, ‘গ্রামে আমাদের বাড়ি ছিল নদীর ধারে। কাজ করে ভালোই চলতো সংসার কিন্তু বন্যায় ঘরবাড়ি সব নদীতে ভেসে যায়। তখন আমরা শহরে চলে আসি একবারে। এখানে এসেও মাঝে মাঝে ঘর ভেঙে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ করে দেওয়া হয় আমাদের। এছাড়াও খাবার পানি সমস্যা। বিদ্যুৎ পাইনা, পয়োঃনিষ্কাশনের সমস্যাসহ অনেক সমস্যার মধ্যে আমরা এখানে বসবাস করি। আমাদের মতন ঘরবাড়ি হারা মানুষের জন্য তহবিল গঠনের দাবি জানাচ্ছি। আমরা এই দেশের নাগরিক আমাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।’
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের এই বস্তিতে বসবাস অধিকাংশ পরিবারই বিভিন্ন দূর্যোগে তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে গ্রাম থেকে এখানে চলে এসেছেন একবারে। আমাদের এই বস্তিতে আস্তে আস্তে বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের সন্ধানে মানুষ আসার প্রবণতা বেড়ে গেছে। গ্রাম অঞ্চলে কাজ হারিয়ে তারা শহরে আসছেন কাজের সন্ধানে। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি, খরা, ঝড়সহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সমস্যার কারণে গ্রাম এলাকায় কাজ কমে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংসার খরচ এখন বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। তাই চাহিদা মিটাতে শহরে আসতে বাধ্য হতে হয়েছে আমাদের। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নই। তবুও আমরা আজ ভূমিহীন উদ্বাস্তু হয়ে গেছি। বস্তিগুলোতে দিনকে দিন গ্রাম থেকে আশা মানুষের চাপ বাড়ছে। ফলে আমাদের বস্তিগুলোতেও নানা ধরনের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা নগর প্রান্তিক আমাদের মতন মানুষদের জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের জোর দাবি জানাচ্ছি।’
মূলত সারা দেশের ভূমিহারা, বেকার, জলবায়ু দুর্গতরাই নগরের বস্তিতে ঠাঁই নিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বস্তিতে বসবাস মানে পানি, টয়লেট, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তা কার্যক্রমের বাইরে পড়ে যাওয়া। এতে সবচেয়ে ভোগে শিশু ও নারীরা। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পয়োসুবিধা নেই বললেই চলে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা সংকটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে রাজশাহী নগরীর বহরমপুর বস্তিতে বসবাস রত প্রান্তিক মানুষগুলো মাত্রা অতিরিক্ত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সব থেকে বেশি দায়ী দেশগুলোকে লাল কার্ড দেখানোর কর্মসূচি পালন করেন। কর্মসূচীতে প্রান্তিক এই মানুষগুলো নগর প্রান্তিকদের জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের দাবি জানান।