শ্যামনগরে দিনকে দিন মাটির শক্তি হ্রাস পাচ্ছে
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে চম্পা মল্লিক
বারসিক’র উদ্যোগে সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামের সরমা রানীর বাড়িতে ‘কৃষি জমি ও মাটির স্বাস্থ্য এবং বর্তমান সমস্যা ও অবস্থা’ সম্পর্কে আলোচনা সভা হয়েছে সভায় ১৬ জন নারী ও ৬ জন পুরুষ উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে বারসিক কর্মকর্তা চম্পা রানী মল্লিক সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের কাছ কৃষিজমি ও মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে অতীত ও বর্তমান চিত্রের নানান বিষয় জানার চেষ্টা করেন। প্রশ্ন পর্বের এক পর্যায়ে গীরেন্দ্র নাথ মন্ডল(৬৭) বলেন, ‘পূর্বে শীত মৌসুমে শীত, গরমের সময় গরম এটা ঠিক ছিল। শীত ও গরম সময়মত হত, তখন একফসলী ফসল ছিল, যেমন-পাটনাই, ধুলোবীজ, গেতী প্রভৃতি। তখন জমিতে প্রচুর ঘাস হত এবং জমি চাষ দেওয়ার পরে এই ঘাস পচে সার হিসেবে পরিণত হত। তাই তখন জমিতে কোন সার ব্যবহৃত হতো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তখন বিঘাপ্রতি ১০-১৩ মণ ধান হতো এবং খরচ ও খুব কম ছিল, তবে বর্তমানে বিঘাপ্রতি ২০-২৫ মণ ধান হয় কিন্তু জমিতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, ফলে প্রতি বিঘাতে ৫০০০-৬০০০ টাকা খরচ হয়। এখন সময়মত কোনটাই হয় না। বর্তমানে মাটিতে শক্তি নেই, ফলে রাসায়নিক সার বৃদ্ধি পাচ্ছে, সময়মত বৃষ্টি না হওয়ায় মাটির শক্তি কমে যাচ্ছে এবং ধান শুকিয়ে মারা যাচ্ছে।
, বৈজ স
মাটির শক্তি সম্পর্কে সরমা রানী (৪২) বলেন, ‘পূর্বে মাটির শক্তি খুবই ভালো ছিল। তখন জমিতে মাত্র ৩ বার যাওয়া লাগতো সে হলো জমি চাষ দেওয়া, ধান লাগানোর সময় ও কাটার সময়। তখন ফলন বেশি ও পুষ্ট হতো।’ বর্তমানে মাটির শক্তি সম্পর্কে মনদ্বীপ মন্ডল (৫৩) বলেন, ‘দিনদিন মাটির শক্তি হ্রাস পাচ্ছে।’
এই প্রসঙ্গে গীতা রানী (৬০) বলেন, ‘আগে জমিতে অনেক উপকারী পোকামাকড় দেখা যেত যেমন-ব্যাঙ, মাকড়সা, ফড়িং, কেঁচো, সাপ, জোঁক, ঝিনুক, শামুক। কিন্তু এখন এগুলো খুবই কম। এদের মধ্যে কিছু কিছু একেবারেই নেই বললেই ভুল হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে ব্যাঙ কেঁচো বড়শীতে গেঁথে বিল ও পুকুর থেকে বড় ছোট বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরতাম, ঝিনুক ও শামুক ভেঙে হাঁস মুরগিকে খেতে দিতাম যাতে তারা দ্রুত বড় হত ও বেশি বেশি ডিম পাড়তো। কিন্তু এখন এগুলো দেখাই যায় না প্রায়। তবে একটা জিনিস একেবারই নেই তা হল জোঁক।’
অন্যদিকে যমুনা রানী (৪৫) বলেন, ‘আগে মাটিতে কোন লবণ ছিল না। তখন যা লাগানো হত তাই ভালো হতো। আর তখন অধিকাংশ মানুষ ধান ও সবজি চাষ করতো। কিন্তু আস্তে আস্তে কিছু মানুষ ঘের করতে থাকে, ফলে কৃষি জমিতে লবণ ঢোকা শুরু হয় এবং আইলার পরে সব জমিতেই লবণ ঢুকে যায়। তখন মানুষ মাছের সাথে সাথে কাঁকড়া চাষে আরো বেশি ঝুঁকে পড়ে যা এলাকার ধান ও সবজি চাষে আগ্রহী ব্যক্তিদের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।’
আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা সকলেই মনে করেন, মাটির শক্তি সবচেয়ে হ্রাস পেতে থাকে আইলার পর থেকে। এখন আর খোলা মাটিতে আলু লাগানো যায় না। নোনা কেটে উঠে, তাই আলু লাগানোর পরে নাড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া লাগে, এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিষ, সার ব্যবহার করা লাগে। কিন্তু আগে এসব করা লাগতো না, যেমন তেমন মাটি কুপিয়ে আলু বীজ পুতে দিলেই হতো।
তারা জানান, সার বলতে আগে শুধুমাত্র মানুষ গোবরকেই বুঝতো। আর তাই গোবর দিয়েই সবজি চাষ করতো। সেসময় সব কিছুর চেহারা ও স্বাদ যেমন ছিল তা আর এখন নেই। আর হবেই বা কি করে, বর্তমানে চাষের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় টিএসপি, ইউরিয়া, এমপি, জিপ সার, ড্যাপ সার ইত্যাদি।
আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন, বর্তমানে জমির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল লবণাক্ততা। এখন ফসল ফলাতে গেলে প্রচুর সার ও বিষ ব্যবহার করতে হয়। প্রতিবছর সার বিষের পরিমাণ বাড়াতে হয়। উপরোক্ত সকল সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য অংশগ্রহণকারীরা রাসায়নিক সার ব্যবহার বন্ধ করে জৈব সার ব্যবহার, জৈব সার তৈরিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।