খাদ্য সংরক্ষণে লোকায়ত চর্চা
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
মানুষের প্রধান পেশা হলো কৃষি। আর এ কৃষিকে ঘিরেই তাদের জীবনাচার। এই জীবনাচারের একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন নারীরা। নিত্যদিনের কাজের অংশ হিসেবে নারীরা খাদ্য তৈরি ও পশু পালনের কাজ করে থাকেন। শুধু তাই নয়, বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সব্জী চাষ করে একদিকে যেমন সংসারের চাহিদা পূরণ করেন তেমনি স্বয়ং সম্পূর্ণ ব্যবস্থার সূচনাও করেছেন। কৃষিতে নারীরা শুধু বৈচিত্র্যই নিয়ে আসেননি, পরিবারের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন আনেন।
তাই কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য বললে নারীর নামটা সবার আগে চলে আসে। বলা যায়, কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রকৃতির সাথে আমাদের নারীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যুগ যুগ ধরে অমাদের নারীরাই মূলত নিজস্ব কায়দায় বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের বীজ ও খাদ্য উপকরণ সংরক্ষণ করে আসছেন। এটাই তাঁদের নিজস্ব জ্ঞান বা লোকায়ত জ্ঞান।
আধুনিক কৃষির তথাকথিত উন্নয়ন বা আগ্রাসন কেড়ে নিতে পারেনি আমাদের নারীদের দীর্ঘদিনের চর্চা। এখনো তাঁরা বাড়িতে অতিথি এলে নানান ধরণের নকশা তোলা পিঠা বানায়। সোয়াই (হাতে তৈরি বিশেষ ধরণের সেমাই) তৈরি করে অতিথি আপ্যায়ন করেন। এছাড়া তাঁরা বিভিন্ন ধরণের খাদ্যোপকরণ বা ফল শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। তার মধ্যে আম একটি অন্যতম ফল। কাঁচা আমের শুকনো অবস্থাকে ‘ফলসি’ বলে। এই ফলসি আবার দুই ধরণের হয়। কাঁচা আম শুকনো হলো ফলসি আর পাকা আম রস করে শুকানোকে আমসি, আমতা বা আমসত্ত বলা হয়। তবে আমসির চাইতে গ্রামাঞ্চলে ফলসি বেশি প্রচলিত।
বৈশাখ/জ্যৈষ্ঠ মাসে কচি আম যখন ঝড়ে বা বাতাসে মাটিতে পড়ে যায় তখন গ্রামের ছোট শিশুরা এগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসে। নারীরা অবসর সময়ে বসে সেই আম ফালি করে কেটে রৌদ্রে দেয়। বেশ কয়েকদিন রোদে শুকানোর পর তা শুকিয়ে ফলসি হয়ে যায়। তখন খাওয়ার উপযুক্ত হয়। কৃষাণীরা বৈয়ামে ভরে সংরক্ষণ করেন। মাঝে মাঝে রোদে দিলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
গ্রাম বাংলার একটি অতি জনপ্রিয় খাবার এটি। গরমের দিনে ছোট মাছ দিয়ে ‘চুহা’ (টক জাতীয় এক ধরণের খাবার) রান্না করে খেতে বেশ লাগে। এখন ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। ধানের জমিতে এখন ধান নেই। বৃষ্টির পানি জমেছে। সেই পানিতে স্থানীয় জাতের ছোট মাছের অবাধ বিচরণ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন মাছ ধরছে। এই মাছ দিয়েই চলে ফলসি দিয়ে চুহা রান্না। বাড়ির সকল বয়সের সদস্যরা এটি খেতে খুব ভালোবাসে।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের দরুন হাসামপুর গ্রামের হোসনা আক্তার বলেন, “অনেক সময় খালি মাছ দিয়া তরকারী খাইতে ভালো লাগেনা, উন্না উন্না লাগে। ফলসি দিলে খুব স্বাদ অয়। গরমের দিনে কইলজাডা ঠাণ্ডা অয়। এছাড়াও ফলসি পোলাপানে ভর্ত্তা বানায়া খায়। বাড়িতে কোনো বাজার না থাকলেও চলে। ফলসি দিয়া একদিনের খাওন চলে। এইডা আমরার গরীবের গোশ্ত। কারো সর্দি বা জ্বর অইলে ফলসি ভর্ত্তা খাইলে মুখে রুচি অয়।”
এই ফলসি নারীরা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও পাঠায়। যাদের বাড়িতে আম গাছ নাই সে সব আত্মীয়রা ফলসি দিতে পারেনা। তারা আব্দার করে। যারা বেশি করে ফলসি দেয় তারা বাজারেও বিক্রি করে কিছু টাকা রোজগার করতে পারে।
এই ফলসি একদিকে যেমন খাবারের অভাব পূরণ করে, পুষ্টি যোগায় তেমনি নারীদের আয়ের একটি উৎস। নারীরা তাঁদের অভ্যাস বশতই এই ফল সংরক্ষণ করেন। গ্রামের প্রতিটি ঘরে খাবারের এই উপকরণটি অতি পরিচিত ও জনপ্রিয়।