জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কৃষকদের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর
রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাংশের মোট ১১ জেলার ৭ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চল। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলার ১,৬০০০০ হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর এবং নওগাঁ জেলার পোরশা ও সাপাহারের আবহাওয়া বেশি রুক্ষ বলে এগুলোকে ‘ঠাঁ ঠাঁ’ বরেন্দ্র বলা হয়ে থাকে। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে কার্টারের ১৯২৮ সালের সেটেলমেন্ট রিপোর্টে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলকে উঁচু, গ্রীষ্মকালে শুধু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম ও বনের ভগ্নাংশ ব্যতীত সমগ্র বরেন্দ্র ছায়াহীন ধুধু প্রান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলে শুধু বৃষ্টি নির্ভর আমন ধান ব্যতিত তেমন কোন ফসল চাষ হতো না। বছরে ৭-৮ মাস জমি পড়ে থাকতো। তবে ৮০’র দশকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে সেচের সুবিধা করায় এই এলাকাগুলোতে তিন আবাদী ফসল চাষের আওতাভুক্ত হয়। কিন্তু তখনকার সময়ে এই ব্যবস্থা কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হলেও সেই আশীর্বাদ বর্তমানে এখন বরেন্দ্র এলাকার মানুষের জন্য চরম সংকটের কারণ। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, নলকূপগুলোতে আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তার উপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা ও শীতের তাপমাত্রার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে যা আমরা বিগত কয়েক বছর হলো লক্ষ্য করছি। এ অবস্থায় বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গবেষণার মাধ্যমে তাই কৃষকদের ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে মাটিতে পানির স্তর বৃদ্ধি, মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি, রস ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ধান চাষের পরিবর্তে বোরো মৌসুমে এলাকা উপযোগী মসলা জাতীয় ফসল চাষ করার পরামর্শ প্রদান করছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধিতে যেমন বোরো ধান চাষের পরিবর্তে মসুর, মটর, ছোলা, গম, সরিষা, ভুট্টা, কালোজিরা, ধনিয়া ইত্যাদি ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। মুগডাল চাষের পর এর গাছ মিশিয়ে দিলে আবার ধৈঞ্চা ফসল চাষ করলে মাটিতে জৈব পদার্থ বৃদ্ধি পায়। প্রতিফল উপলব্ধি করায় বর্তমানে ধান চাষের পরিবর্তে বাড়ছে অন্যান্য ফসলের চাষ।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, খরার প্রভাব কমানো, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধিকরণে তাই বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের বড়শীপাড়া গ্রামের কৃষকরা সম্মিলিতভাবে চলতি মৌসুমে এলাকা উপযোগী মসলা ও ডাল জাতীয় ১২ ধরনের জাত নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এ সম্পর্কে কৃষক মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের বাবারাও এই শলুক, রাধুনী, কালোজিরা, কুসুম ফুল, শুল্টি কালাই কোনদিন চাষ করেনি, চোখেও দেখেনি। এই এলাকায় এই ফসলগুলো হতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণায় ছিল না কিন্তু এবার পরীক্ষামূলকভাবে ১২ জাতের ফসল নিয়ে গবেষণা করার ফলে আমাদের ধারনা হলো এই ফসলগুলো আমাদের এলাকার জন্য উপযোগী, আগামী বছর আমরা বেশি পরিমাণে এই ফসলগুলো চাষ করব।”
বারসিকের সহযোগিতায় বড়শীপাড়া গ্রামের কৃষকদের এই গবেষণা প্লটটি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ তারিখে পরিদর্শন করলেন গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আকবর হোসেন। প্লট পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবলায় কৃষকদের এই উদ্যোগ আসলেই প্রশংসনীয়। এই উদ্যোগগুলো পাশের গ্রামের মানুষদের মাঝে সম্প্রসারণ করতে হবে যাতে অন্যরাও এই মসলা জাতীয় ফসলের সাথে পরিচিত হতে পারে এবং পানির স্তর বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।” তিনি কৃষকদের মুগডাল ও চীনা চাষ করার পরামর্শ প্রদান করেন এবং চাষের বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
গবেষণা প্লটটি পরিদর্শনের পর আলোচনা কালে কৃষকরা কৃষি কর্মকর্তার কাছে দাবি করেন মাসে অন্তত একদিন তিনি যেন আলোর পথে তরুণ সংঘের অস্থায়ী ক্লাব ঘরে বসেন, যাতে কৃষকরা তাদের কৃষি সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারে এবং পরামর্শ নিতে পারে।