কৃষিতে অনুকরণীয় রোকিয়া আক্তার’ এর অবদান
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
ইতিহাস পাঠ করে আমরা জানতে পারি কৃষির সূচনাকারী হলো নারী। নারীই প্রথম বীজ থেকে শস্য ফলিয়ে উৎপাদন কাজের সূচনা করেছিলেন। বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় চাষ, জমি প্রস্তুত, বীজ রোপণ, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বিনিময়, ফসলের যতœ ইত্যাদি কাজগুলোতে নারীরাই বেশি দক্ষতার পরিচয় দেয়। এদেশে হাজারো নারী কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এমনই একজন গ্রামীণ নারী কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামের কৃষাণী রোকিয়া আক্তার (৪৫)।
স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ রোকিয়ার সংসার। তার সহায় সম্বল বলতে বাড়িভিটাসহ মাত্র ৪০ শতাংশ জমি। নগুয়া গ্রামে এক বীজ মেলায় রোকিয়া আক্তার স্থানীয় ৭ জাতের মরিচের বীজসহ ৯০ জাতের ধান, সবজি ও অন্যান্য শস্য বীজের প্রদর্শন করেন। রোকিয়া আক্তার এসব শস্য বীজ শুধু সংগ্রহই করেন না, তিনি নিজেও এসব শস্য চাষ করেন। তার সংগৃহীত এসব বীজ তিনি গ্রামের অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বিনিময় ও বিক্রি করেন।
এক সময় গ্রামীণ কৃষক-কৃষানীরা বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় শস্য বীজের চাহিদা পূরণ করতেন। বীজের জন্য কৃষকরা বাজারের উপর নির্ভরশীল ছিল না। বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে শুধু যে, বীজের চাহিদাই পূরণ হত তাই নয়, পাশাপাশি গ্রামের মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও সামাজিক বন্ধনও হতো সুদৃঢ়। কিন্তু বর্তমানে বীজ বিনিময় প্রথা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে, কৃষকরা এখন বাজারের উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড বীজের উপর নির্ভরশীল হয়েছে পড়েছে। এর ফলে লোপ পাচ্ছে পারস্পারিক সম্পর্ক, ভেঙে পড়ছে আন্তঃনির্ভরশীলতা ও দূর্বল হয়ে পড়েছে সামাজিক বন্ধন।
রোকিয়া আক্তারের নিজস্ব তেমন জমি না থাকায় অন্যের থেকে জমি বর্গা নিয়ে জমিতে সবজি ও ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষ করেন এবং বীজ সংরক্ষণ করেন। তিনি সংরক্ষিত এসব বীজ গ্রামের অন্য কৃষক-কৃষাণীদের সাথে বিনিময় ও বিক্রি করা ছাড়াও গ্রামের মানুষের বিপদে আপদে এগিয়ে আসেন। গ্রামের নারীদের সাথে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লেখাপড়ার পাশাপাশি কাঁথায় নকশী তোলা ও বেতের কাজ করেন। তার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের অন্য নারীদের মাধ্যে নতুন উদ্যমে বীজ বিনিময়ে প্রথা আবার চালু হয়েছে, গ্রামের নারীরা কাঁথায় ও কাপড়ে নকশীর কাজ ও বেতের কাজে যুক্ত হচ্ছে। গ্রামের প্রায় সকল নারী এসব কাজে যুক্ত হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের নারীদের মধ্যে বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিনিময়ের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের যেসকল নারী সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিনিময় করছেন তাদের মধ্যে জাহানারা আক্তার, দিলজুরা, জামেলা, রোমেলা, জোসনা উল্লেখযোগ্য।
রোকিয়া আক্তার কেঁচো কম্পোস্ট ও কচুরিপানা দিয়ে জৈব সার তৈরির অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মাটিকাটা ও দলপা গ্রামে অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে অংশগ্রহণ করেন। পরিবেশকে সুন্দর ও প্রাণবৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। রোকিয়া আক্তার প্রতি মৌসুমে শাকসবজি চাষ করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের সবজি দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন এবং উৎপাদিত লাউ, ডাটা, সীম, ঢেড়স, কুমড়া, মরিচ, ধনিয়া ইত্যাদি বিক্রি করে চলতি মৌসুমে প্রায় ৮৯,০০০ টাকা আয় করেছেন। সবজি চাষের আয় দিয়েই চলে তার সংসার ও ছেলে মেয়ের পড়াশুনার খরচ। গত বছর (২০১৬) সবজি থেকে আয়ের ১০০,০০০ টাকা তিনি মেয়ের নামে ব্র্যাক ব্যাংকে সঞ্চয় করেছেন। বিভিন্ন কৃষি মৌসুমের শুরুতে রোকিয়া কৃষি জমি প্রস্তুত, বীজ রোপণ, সবজি বাগানের পরিচর্যা, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং বীজ বিনিময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে গ্রামের অন্যান্য কৃষানীদের সাথে মত বিনিময় করেন, যাতে তারা সঠিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে লাভবান হতে পারে।
২০১৬ সাল থেকে চলতি সময় (জানুয়ারি/‘১৭) পর্যন্ত রোকিয়া আক্তার নিজ গ্রাম ছাড়াও পার্শ্ববর্তী প্রায় ১৩টি গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বীজ বিতরণ করেছেন। বীজ বিতরণকৃত গ্রামগুলো হল-আশুজিয়া, ভবানীপুর, পাড়ার্দূগাপুর, সিংহেরগাঁও, রাজীবপুর, দলপা, রামপুর, নগুয়া, ঘোষখিলা এবং আটপাড়া উপজেলার-নোয়াপাড়া, জালসুখা, তিলকপুর, রামেশ্বপুর। এসব গ্রামগুলোতে তিনি যেসব শস্য বীজ বিতরণ ও বিনিময় করেছেন তার মধ্যে লাউ, সীম, মাসকলাই, মটর, মিষ্টিকুমড়া, শসা, কালো মরিচ, মুক্তা ধান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বিনিময় এবং পরিবেশসম্মত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি নিজ গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের সাথে সহভাগিতার ফলে এখন গ্রামের অধিকাংশ মানুষই তাদের উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করছেন এবং প্রয়োজনে পরস্পরের সাথে বিনিময় করছেন। রোকিয়া আক্তারের সহযোগিতায় ও পরামর্শে গ্রামের কৃষকদের বীজের জন্য পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বীজের জন্য তাদের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পেয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে রোকিয়া আক্তারের অবদান কৃষির স্থায়িত্বশীলতা আনতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে স্থানীয়রা আশাবাদী। সকল গ্রামে, সকল সমাজে ও সকল সময়ে রোকিয়া আক্তাররাই কৃষির হাল ধরে আসছেন এবং স্থানীয় জাতের শস্য ফসল চাষ করে কৃষিকে টিকিয়ে রেখেছেন এবং আগামীতেও রাখবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা।