সূর্যের আলোয় বদলে যাওয়া জীবন
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
যতদিন আমাদের এই পৃথিবী থাকবে, ততদিন থাকবে সূর্যের আলো। পৃথিবী থেকে সূর্যের দুরত্ব প্রায় ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল। সেই দূরত্ব থেকে সূর্য প্রতিদিন বিলিয়ে যাচ্ছে অপরিসীম শক্তি। সূর্যের আলোয় যেমন অন্ধকার দূর হয় তেমনি এর আলোক শক্তিকে তাপ শক্তিতে রুপান্তর করে আমরা দৈনন্দিন অনেক কাজ করতে পারি। এই অনেক কাজের মধ্যে একটি রুপান্তরিত কাজ হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ। যে সমস্ত গ্রামে বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি, সে সব গ্রামে সৌর বিদ্যুতই একমাত্র ভরসা।
এমনই একটি গ্রাম লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের গদাইকান্দি। এই গ্রামে ১৬৯টি পরিবার থাকলেও সকল পরিবার বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসেনি। গ্রামের অধিকাংশ পবিারগুলোতে একটি করে কুপি বাতি বিভিন্ন কাজ যেমন, রান্না করা, খাবারের সময় বা বাইরে যাওয়ার কাজে ব্যবহার করে। যে কারণে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘœ ঘটে, তারা অমনোযোগী হয় এবং প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনা। অনেক সময় রাতের পড়া তাদের বিকেলেই সেরে ফেলতে হয়। ফলে যে সময়ে ছেলেমেয়েরা খেলা ধূলা বা আনন্দ করে, সেই সময়টাও তারা পায়না। তাছাড়া কুপির আলোতে পড়লে চোখ জ্বালা করে, ঘরে কালি জমে, জামা কাপড় ময়লা বেশি হয়।
এই গ্রামেরই বাসিন্দা শিউলি আক্তার। তাঁর স্বামী একজন দরিদ্র কৃষক। নিজস্ব জমি নেই বললেই চলে। তাঁর পরিবারে লোক সংখ্যা ৪ জন। তিনি, তাঁর স্বামী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে। পরিবারে ৪ জন সদস্যর জন্য সার্বক্ষণিক আলোর ব্যবস্থা নেই, নেই কোন ধরণের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। রাতের বেলায় ঘরের বাইরে যেতে হলে কুপি বাতিই তাদের একমাত্র ভরসা। শিউলি আক্তারের ছেলেমেয়ে সবসময় কেরোসিনের বাতির সাহায্যে পড়া লেখা করতো। গরমের দিনে সন্ধ্যার সময় ছেলে মেয়েরা গরমের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে পড়ালেখা করতো। এ সময় তারা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে। কিন্তু অনেক সময় কুপি নিভে যাওয়ার ভয়ে বাতাস করতোনা। গামছা ভিজিয়ে বারে বারে শরীর মুছে নিতো। রাতে জানালা খুলে পড়তে বসলে যদিও বা গায়ে বাতাস লাগতো কিন্তু বাতাসে কুপি নিভে যেতো। তাই কুপিটিকে নিভে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কোনো খলই বা চুকরার ভিতরে রাখতো। অনেক সময় কুপির তেল কিনতে পারতোনা। ফলে তাঁর ছেলেমেয়েরা বিকেলেই স্কুলের পড়া শেষ করতে হতো।
রাতের রান্নাটাও শিউলি আক্তার বিকেলে শেষ করে ফেলতেন। পাছে কুপির তেলে টান পড়ে। যদি কোনো সময় রাতে রান্না করতে হতো তখন একটি কুপি দিয়ে ছেলে মেয়ে পড়তো আর একটি কুপি দিয়ে তিনি রান্না করতেন। কোনোদিন এমনও হয়েছে যে, রাতে পরিবারের সবাই মিলে খেতে বসেছেন, এমন সময় কুপির তেল ফুরিয়ে গেছে। তখন খাওয়া বন্ধ রেখে প্রতিবেশি বাড়ি থেকে তেল এনে কুপি জ্বেলে তারপর খাবার শেষ করতে হয়েছে। প্রতিদিন এমন অনেক ধরণের ঝামেলা তাদের পোহাতে হতো।তাঁর মেয়েটি কলেজে পড়ে। তার পড়া শেষ করতে সময় লাগে বেশি। তাই অনেক রাত পর্যন্ত কুপি জ্বেলে রাখতে হতো। দরজা, জানালা বন্ধ করলে কুপির ধোঁয়ার কারণে সারা ঘরে অন্ধকার দেখা যেতো। তাছাড়া দীর্ঘ সময় কুপির ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করতো। ঘরে থাকা সব কাপড়ে কালি জমে যেতো।
এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজছিলেন। তাঁর দরিদ্র পরিবারে যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে সৌর বিদ্যুৎ কেনা অকল্পনীয় ছিলো। ইচ্ছা এবং প্রয়োজনীয়তা থাকা স্বত্তেও টাকার অভাবে তাঁরা এর সুবিধা নিতে পারছিলেন না। এ জন্য তাঁদের প্রায় এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। শিউলি আক্তার তাঁর বাড়িতে হাঁস, মুরগি পালন করতেন। নিজেরা না খেয়ে ডিম ও হাঁস, মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে দিতেন। খাবারের চাল থেকে অল্প অল্প সঞ্চয় করে তা বিক্রি করে দিতেন। এভাবে তিনি এক বছরে পাঁচ হাজার টাকা জমা করেন। অভাবের সংসার। তাই মাঝে মাঝে বিশেষ প্রয়োজনে এই জমা টাকায় হাত দিতে হতো। আবার ডিম বা মুরগি বিক্রি করে সেই খরচ করা টাকা পূরণ করে নিতেন। অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে তিনি একটি সৌর বিদ্যুৎ কিনেছেন। এই সংযোগে তিনটি লাইট আছে, তবে ফ্যানের সংযোগ নিতে পারেননি। কারণ এর জন্য আরো টাকার দরকার। কিন্তু এতেই পুরো পরিবার খুশি। কারণ তাদের সমস্যা অনেকটাই সমাধান করতে পেরেছে। তাঁর ঘরের চালে গাছের ছায়া পড়ে, তাই তিনি সোলার প্যানেলটি বাড়ির উঠানে একটি বাঁশের মাথায় বেঁধে রেখেছেন।
বর্তমানে তাদের কেরোসিন তেল কিনতে হচ্ছেনা। এই তেল বাবদ যেখানে মাসে ২১০ টাকা খরচ হতো কিন্তু এই খাতে কোনো খরচ নেই। তাছাড়া সৌর বিদ্যুতের সাহায্যেই মোবাইল চার্জ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মোবাইল চার্জ দেওয়া বাবদ আরো ১৫০ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে তাঁর (২১০+১৫০)=৩৬০ টাকা খরচ কমেছে।
সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়েছে ছেলেমেয়ের পড়ালেখায়। কলেজ পড়–য়া মেয়েটি এখন অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে পারে। গরমের সময় রাতে জানালা খুলে পড়তে বসলেও কুপি নিভে যাওয়ার ভয় নেই। পাখা দিয়েও বাতাস করতে পারে। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করতে পারে। চোখ জ্বালা করেনা। ঘরের কাপড়ে কালি জমেনা। শিউলি আক্তারের ছেলেটি বিকেলের সময়টুকু খেলা ধূলা করে কাটাতে পারে।
এখন শিউলি আক্তার রাতে রান্না করতে পারেন। প্রতিদিন কুপিতে তেল ভরা বা সলতে পাল্টানোর ঝামেলা নেই। মোবাইল চার্জ দিতে এখন আর বাজারে যেতে হয় না। আলো থাকার কারণে স্বচ্ছন্দে ঘরের কাজ করা যায়। তাছাড়া শিউলি আক্তারের স্বামী একটি চার্জার লাইট কিনেছেন। যেটি ব্যবহার করে রাতে তারা বাইরে যেতে পারেন। নিরাপত্তা হীনতায় ভুগতে হয় না।
একজন সাধারণ দরিদ্র পরিবারের নারী যে কিনা কোনো ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত নয়, তিনি নিজের সামান্য সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অভাব পূরণ করেছেন। অনেকে অর্থবিত্ত থাকা স্বত্তেও এধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনা। যারা অর্থ আয়ের সাথে যুক্ত অর্থাৎ কোনো চাকুরী বা ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করেন তারা সম্পদশালী। কিন্তু একজন গ্রামীণ দরিদ্র নারীর কাছে সম্পদ হলো তাঁর পালিত প্রাণি সম্পদ, গাছ ভরা সব্জী। সময়ের প্রয়োজনে, নিজস্ব চাহিদায় সেগুলোকে তাঁরা সঠিক কাজে ব্যবহার করেন।