বৃহৎ শিল্পের উপেক্ষিত শ্রমিক জনগোষ্ঠি

যশোর থেকে মো. মফিজুর রহমান
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমিক সেক্টর হচ্ছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানের (সুইটমিট) শ্রমিক সেক্টর এত বড় একটি শ্রমিক সেক্টর হওয়া সত্ত্বেও এ সেক্টরকে দীর্ঘদিন শিল্প হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিলেও এখনও শিল্পরূপ না দেওয়ায় শ্রমিকরা যারপর নাই সমস্যা-সংকটে জর্জরিত। এখানে কার্যকর নেই বাঁচার মত নূন্যতম মজুরি, কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি এমনকি থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তাও নাই। তদুপরি প্রায়শই চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, গাড়ি ভাড়া, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদির দফায় দফায় বৃদ্ধি শ্রমিকদের জীবন-জীবিকাকে অনিশ্চিত করে তুলছে। লাভজনক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুইটমিট ব্যবসায় নিয়োজিত মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা গ্রহণ করে চলে।

18118467_2287960041429931_4022613276805869767_nএ অবস্থায় হোটেল শ্রমিকরা কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়। এখানে নেই নির্দিষ্ট ৮ ঘন্টা শ্রম সময়, দেওয়া হয় না ন্যায্য মজুরি। ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরির ব্যবস্থা নেই, শ্রম আইন অনুযায়ী দেওয়া হয় না নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক, হাজিরা খাতা, উৎসব বোনাস, সাপ্তাহিক ছুটি, নৈমিত্তিক ছুটি, অর্জিত ছুটি, মেডিকেল ছুটিসহ সকল ধরনের আইনী অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে হোটেল শ্রমিকদের। এ সকল আবশ্যিকতা আইন-আদালত, কোট-কাচারী, প্রশাসন ও সরকার স্বীকার করলেও এমনকি মামলার রায় শ্রমিকদের পক্ষে গেলেও মালিকরা তা কার্যকরী করে না। আর এ সমস্ত আইনী কাগজপত্র মালিকরা না দেওয়ায় শ্রমিকরা তাদের ন্যয্য অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে ও হয়রানির শিকার হয়। শ্রমিকরা তার আইনসংগত পাওনার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হলে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারায় শ্রমিককে মিথ্যা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে বিচারক ফৌজদারী মামলা দেওয়ার নির্দেশের মত ঘটনা ঘটে। এমন এক পরিস্থিতিতে হোটেল সেক্টরের শ্রমিকরা রাজধানী-মহানগর-জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংগঠিত হয়ে অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয়।

1এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য হোটেল শ্রমিকরা সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করার চিন্তা করতে থাকে। বাংলাদেশ হোটেল রেষ্টুরেন্ট মিষ্টি বেকারী শ্রমিক ইউনিয়ন যশোর জেলা শাখার সভাপতি আমির হোসেন বলেন, “দেশের হোটেল সেক্টরে অনিয়ম, ছাঁটাই, মালিকের খামখেয়ালীপনা সাথে নিয়েই চলতে হয় শ্রমিকদের। হোটেল শ্রমিকদের ১২ ঘন্টার বেশী ডিউটি করতে হয়। বেশির ভাগ জেলা শহরসহ উপজেলা শহর ও জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোতে ১৬-১৮ ঘন্টাও অনেক শ্রমিকের জন্য অবশ্য প্রযোজ্য। বেশিরভাগ হোটেলে গ্লাসবয়, টেবিলবয়, কারিগর বা মেসিয়ার একজনকেই অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়।” কোন অবসর নেই- এটা রেখে সেটা কর ইত্যাদি। অর্থাৎ শ্রম আইনের কোন বালাই নেই। নূন্যতম মজুরি ও গেজেট বাস্তবায়নের কোন কার্যকরি উদ্যোগ নেই। এ সংকটাপন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্দোলনকে অগ্রসর করার জন্য রমজান মাসে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করে দিনের বেলা হোটেল খোলা রাখা এবং ঈদ উৎসব মূল মজুরির সমহারে বোনাসের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করে জোরদার করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় মালিক সমিতির সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করে ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল মালিক সমিতির সাথে ফেডারেশনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে শ্রম আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী সরকার ঘোষিত নূন্যতম মজুরি এবং এর সাথে বোনাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কার্যকরী করার জন্য শ্রম আইন বাস্তবায়নের উপর জোর দেওয়া হয়। এ প্রেক্ষিতে মালিকপক্ষ প্রথমে দ্রুত পরিচয়পত্র প্রদান করে পর্যায়ক্রমে শ্রম আইন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়।

উল্লেখ্য ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে যশোর জেলা শহরে হোটেল শ্রমিকদের মুল বেতনের সমপরিমান বোনাস প্রদান করা হচ্ছে। গোটা ২০ এর মত প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, শহর ও শহরতলি মিলিয়ে প্রায় ৭০-৭৫টির মত ছোট-বড় হোটেল প্রতিষ্ঠান আছে। ১ মে মহান শ্রমিক দিবসে মজুরিসহ ছুটিও শহরের শ্রমিকেরা ভোগ করা শুরু করেছে গত ২/৩ বছর যাবৎ। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটি, নৈমিত্তিক ছুটি, অর্জিত ছুটি, মেডিকেল ছুটিসহ শ্রম আইনের অন্যান্য প্রায় সকল অধিকার থেকে এখনও শ্রমিকেরা বঞ্চিতই বলতে হয়। ২৪ নভেম্বর ২০০৯ সালের পর দীর্ঘ ৮ বছর বিরতি দিয়ে ২০১৭ সালের ১ মার্চ দ্বিতীয়বারের মত নূন্যতম মজুরির গেজেট প্রকাশিত হলেও অদ্যবধি তা বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। দেশে প্রচলিত আইনের শাসন ও শ্রমিকদের জীবন ধারণের স্বার্থে তাদের ন্যূনতম অধিকার রক্ষা তাই প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমনটি আশা করে ভুক্তভোগি শ্রমিকরা।

happy wheels 2

Comments