প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা চরের রাবেয়ার উদ্যোগ
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে উত্তর পাটগ্রামচর পদ্মার নদীর তীর ঘেঁষে বর্তমানে বসবাস করেন রাবেয়া। হরিরামপুর উপজেলার মূলভূমি একঘণ্টা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় উত্তর পাটগ্রামচরে রাবেয়ার বাড়ি। বয়স তার ৫৫ ছুঁই ছুঁই। রাবেয়ার পরিবারে রয়েছে তার স্বামী এক ছেলে এবং ছেলের বউ এবং একজন নাতনীসহ মোট ৫ জন সদস্য। তাঁর ছেলে আলামিনের পেশা হচ্ছে মাছ ধরা এবং কৃষি কাজ করা। স্বামীর নাম আহম্মদ আলী। বয়স ৬৩ বছর। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকলেও রয়েছে তাঁর স্বাক্ষর জ্ঞান। কৃষিভিত্তিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় বাবার বাড়ি থেকে কৃষি কাজ দেখে দেখে বড় হয়েছেন রাবেয়া। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয় নিজ জেলা ফরিদপুর পাশের কানাই পুর গ্রামের আরেকটি কৃষিভিত্তিক পরিবারে আহম্মদ আলীর সাথে। রাবেয়ার স্বামী আহম্মদ কৃষি কাজ করেন। তাঁর পরিবারে ৬৬ শতক নিজস্ব জমি রয়েছে। আর ৬০ শতক অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। রাবেয়ার বর্তমান বসতবাড়ি পদ্মা নদী থেকে আধা কিলোমিটার দুরে অবস্থিত।
বাবেয়ার বাড়ির আশেপাশে আনাচে কানাচে, রাস্তার ধারে সবখানেই রয়েছে শাক-সবজিতে ভরা। মৌসুমভিত্তিক রয়েছে বাড়ির প্রায়ই সকল ফলদ বৃক্ষ। উত্তর পাটগ্রামচর নারী উন্নয়ন সংগঠন রাবেয়ার বাড়িকে ‘শতবাড়ি’র কৃষক হিসেবে নির্বাচন করেছে। সতেজ আর তরুতাজা শাকসবজি দেখে মন জুড়িয়ে যায় পথচারীদেরও। বাড়ি থেকে সপ্তাহে আয় করেন ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। বসতবাড়ি থেকে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল গাছের আয়ের মুল চাবিকাটি অবদান রয়েছে তার। স্বামীর কৃষি কাজের সহায়তার পাশাপাশি নিজ বাড়ির চারিদিকে খেয়াল রাখেন সব সময়। নিজে চাষাবাদ করে গ্রামের অন্যান্য মানুষকে বীজ সহায়তা, পরামর্শ, তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করে থাকেন। চরাঞ্চলে প্রতিবছর বন্যা ও নদীভাঙনের অনেক ফসল বীজ ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অনেক সময় বীজ সংকটে পড়ে চরবাসীর কৃষক। তাই তিনি স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের জন্য নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন বীজ বাড়ি। তাঁর বীজ বাড়িতে ৩৫ ধরনের স্থানীয় জাতের বীজ রয়েছে। পাটগ্রামচর নটাখোলা গঙ্গীধরদি হরিহরদিয়া গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের প্রায় ১২০ জন মানুষকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে গম, পায়রা, ধনিয়া, সজ, শিম, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দল, ঝিংগা এবং পেঁপের বীজ।
রাবেয়া উত্তরপাটগ্রামচর নারী উন্নয়ন সংগঠনের একজন সদস্য। তাঁর দলে রয়েছে ২২ জন সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমাগো বাড়ি চরে। আমরা চরে থাহি, কৃষি কামগাছ নিয়ে আমাগো জীবন চলে। তাই বাড়ির পাশে কোন জায়গা পতিত রাহি না। চাষাবাদ করি কাজে লাগাই। আমার বাড়িতে লাউ. মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দল, বেগুন, করল্লা, শিম, মাছআলু, গাছ আলু, আড়ইলসহ রয়েছে নানান পদের সবজি।’ তিনি আরো বলেন, ‘নারী সংগঠনে মাধ্যমে আমরা মাসে মাসে আলোচনায় বসি সবাই মিলে। আমাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি। সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেই। যেমন: সরকারি সেবা সহায়তা প্রাপ্তিতে, স্বাস্থ্য সেবা, নারীদের অধিকার, বীজ সংরক্ষণ, জৈব বালাইনাশক তৈরি, দুর্যোগ, বাল্য বিবাহসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।’
মানিকগঞ্জ জেলার মধ্যে হরিরামপুর উপজেলা একটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। প্রতিবছর বন্যা, খরা, নদীভাঙ্গন, শিলা বৃষ্টি বজ্রপাতসহ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয় চরের মানুষের। রাবেয়া তাঁর জীবন থেকে ৫৫ বছর পার হয়ে গেলেও দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে থাকার গল্প রয়েছে তাঁর কাছে। তিনি বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি এক বেলা রান্না করতে পারছি এক বেলা রান্না করতে পারি নাই। কলার বুড়া বানিয়ে তার উপর রান্না করে খাইছি। খাওয়ার পানি পাই নাই পাশের গ্রামে একটা স্কুল ছিল সেখান থেকে পানি এনে খেতে হয়েছে। নদী ভাঙ্গনে জমি জমা হারিয়ে অন্যর জায়গায় ঘর করে থাকছি। সে কষ্টের কথা এখনো মনে পড়ে। যখন আমার বয়স ২৫ তখন কানাইপুরে থাকি। নদীভাঙ্গন শুরু হয় একদিনে ৫০/৬০টি বাড়ি নদীগর্ভে চলে যায়। কেউ জিনিসপত্র সরাতে পারছেন আবার কেউ সরাতে পারে নাই। পরপর তিনবার নদীভাঙ্গনে ফলে আগামো জায়গা জমি ঘরবাড়ি বড় বড় আম, কাঠাল গাছ সব কিছু নদীতে চলে যায়। তখন আমরা কোন উপায় না পেয়ে লেছড়াগঞ্জ উত্তর পাটগ্রামচরে আতœীয় মাধ্যমে ১০ বছর আগে চলে আসি।’ রাবেয়া বলেন, সনকরালী ৩৩ শতক জমি নিয়ে বসবাস শুরু করি। আমার জীবনে আমি বড় বড় বন্যা দেখেছি আবার নদী ভাঙ্গন দেখেছি । আমি ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭ ও ২০২০ বড় বন্যা দেখেছি। আর নদীভাঙ্গন দেখছি ৬/৭ বার বড় বড় আকারে। বড় বন্যার আমাদের আমন ধান নষ্ট হয়েছে গাছ গাছালী মরে গেছে গরু/ ছাগল কম রাখার জায়গা পাই নাই। কমদামে বিক্রি করে দিছি। তখন কারো বাড়িতে পায়খানা ছিল না। খাওয়ার পানি পেতাম না। কত শাক সবজি গাছ নষ্ট হয়েছে। চরে বন্যা আসলে সাপ পোকামাকড় বেড়ে যায়। সাপের কামরে মানুষ মারা গেছে। ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেছে। সর্দি জ¦রসহ নানা রোগ দেখা দিয়েছে এবং অনেকের আবার ডায়রিয়া হয়েছে। আমার মনে আছে সবচেয়ে বড় বন্যা হয় ৮৮ সালে। তখন চরে কোন উচা জায়গা ছিল না। মাচা পেতে আমরা থাকছি। আলোক চুলা দিয়ে রান্না করছি। খড়িজাবা গাছের ডালের সাথে বেঁধে রাখছি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ডিঙ্গি বা কলার ভেলা নিয়ে যেতাম। ঘরবাড়ি মাটি সরে গিয়ে জায়গা জায়গা গর্ত হয়ে যেত। গাছ গাছালী সব নষ্ট হয়ে যেত। হাঁস মুরগি কত হারিয়ে গেছে। ঘরের রাখা ফসল পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। চকে ধান পাট পচে গেছে।’
রাবেয়া জানান, আগের দিনে বড় বড় বন্যা হতো নদীভাঙন ছিল বেশি। এখন নদীর পানির ¯্রােত কমে গেছে। নদী অনেক বড় হয়ে গেছে। নদীতে বেশি গভীর নাই। কিছু পানি আসলেই তাড়াতাড়ি চকে চলে আসে। নদী বালি পরে ভরাট হয়ে গেছে। বিশেষ করে বন্যা থেকে রক্ষার জন্য আমরা আগেই থেকে বাড়ি ভিটা উচু করি। ঘরের চারপাশে ডোয়াতে ঘাস লাগাই যাতে ঢেউয়ের কারণে ভেঙ্গে না যায়। গরুর খাদ্য খড়, কালাইয়ের ভূষি সংরক্ষণ করে রাখি। উটু ভিটায় মরিচ বেগুন লাগাই। গরুর জন্য মাটি দিয়ে উচু করে আতাল তৈরি করে রাখি। এসব কাজ আমরা বন্যার আগে করি থাকি।
রাবেয়া স্থানীয় জনসংগঠন উত্তর পাটগ্রামচর নারী উন্নয়ন সংগঠনের একজন সদস্য। নারী সংগঠনে মাধ্যমে আমরা মাসে মাসে আলোচনায় বসেন সবাই মিলে তাদের সমস্যা নিয়ে। সমাধানের জন্য সবাই মিলে উদ্যোগ নেন। যেমন: সরকারি সেবা সহায়তা, স্বাস্থ্য সেবা, নারীদের অধিকার, বীজ সংরক্ষণ, জৈব বালাইনাশক তৈরি, দুর্যোগ, বাল্য বিবাহসহ বিভিন্ন আলোচনা করেন।
বারসিক থেকে রাবেয়ার বীজ বাড়িতে বীজ সংরক্ষণের জন্য মাটির পাত্র ও প্লাষ্টিক ড্রামসহ বিভিন্ন কৌটা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এছাড়াও বীজ মেলা অচাষকৃত উদ্ভিদ মেলায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অভিজ্ঞতা বিনমিয় সফর বৃক্ষরোপণসহ বারসিক নানান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। তাছাড়া বীজ সংরক্ষণ, প্রানী সম্পদ পালন জৈব সার তৈরি প্রশিক্ষণেও অংশগ্রহণ করেন। হরিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে সবজি চাষ প্রদর্শনী পান।
রাবেয়া আগামী পরিকল্পনা বা ভবিষ্যত ভাবনা নিয়ে কথা হলে তিনি জানান, সংগঠনের মাধ্যমে তারা চরের মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্র্যোগ (বন্যা) মোকাবেলায় বীজ বাড়ির গুরুত্ব বিষয়ে জানাতে চাই। বালাইনাশক তৈরি ও সবজি চাষের তথ্য পোকামাকড় দমনসহ তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে সবার মাঝে আলো ছড়িয়ে দিতে চাই। তিনি বলেন, ‘চরের প্রতিটি বাড়ী একটি কৃষিসমৃদ্ধ বাড়ি করতে চাই। স্থানীয় জাতের ফসল চাষের মাধ্যামে সমৃদ্ধ করতে চাই চরের প্রাণ-প্রকৃতিকে।’