জীবন থেকে জীবন কেড়ে নিচ্ছে ‘বাল্যবিবাহ’
আসাদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা থেকে:
‘মেয়ে বড় হচ্ছে, দিন-কালের যে অবস্থা, তাই বিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। আমরা গরিব মানুষ, মেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে পারলে চিন্তা থাকে না।’ সম্প্রতি ইভটিজিংয়ের ভয়ে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাতক্ষীরা পৌর এলাকার বদ্দীপুর কলোনীর আব্দুস সালাম। স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ৯ম শ্রেণির মেয়েটি বাল্য বিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেলেও শিশু বিবাহের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ইভটিজিং। একই সাথে তা তরান্বিত করছে দরিদ্রতা। বাল্য বিবাহের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মেয়ে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ। অপরিণত বয়সে মা হতে গিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি। অপরিণত বয়সী মায়ের সন্তানও পাচ্ছে না শারীরিক পূর্ণতা। বাল্য বিবাহের কারণে বাড়ছে নারী নির্যাতন, ঘটছে বিবাহবিচ্ছেদ ও বহুবিবাহের মতো ঘটনাও। তবে, আশার কথা হলো শিশু বিবাহ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নেয়া হয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচি। এসব কর্মসূচির আলোকে শিশুদের দেওয়া হচ্ছে লাল কার্ড। এই কার্ডের মাধ্যমেই বাল্য বিবাহের ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। স্কুল-মাদ্রাসায় গঠন করা হয়েছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী শিশু-কিশোর রেডকার্ড টিম। যদিও লাল কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ সীমাবদ্ধ রয়েছে সদর উপজেলাতেই। এছাড়া জেলাব্যাপী এলাকায় এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী বিলবোর্ড। সচেতন করা হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক-ইমাম-কাজী-পুরোহিতসহ সর্বস্তরের মানুষকে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদ সূত্র জানা গেছে, ২০১৫ সালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৩২২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৮টিতে পরিচালিত এক জরিপে এক বছরে বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে এমন ৪১২ জনের তথ্য পাওয়া গেছে।
জানুয়ারি ২০১৫ থেকে অক্টোবর ২০১৫ পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাল্য বিয়ে রোধে ৫৫টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে তাৎক্ষণিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেলেও এদের মধ্যে ৫৩ জনই পরবর্তীতে বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। মাত্র দু’জন শিশু স্কুলে ফিরতে সক্ষম হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনিরা পারভীন জানান, বাল্যবিবাহ জীবন থেকে জীবন কেড়ে নেয়। বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে সমাজের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রশাসন তৎপর রয়েছে। পারিবারিক পর্যায় থেকে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি না হলে বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করা কষ্টসাধ্য। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে কাজের নানা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “বাল্যবিয়ের আয়োজন একবার হয়ে গেলে তা আর প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। বাল্যবিয়ের খবর পেলে মোবাইল কোর্ট হয়, কিন্তু সাধারণত পরে মেয়েটিকে অন্যত্র নিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। সে আর স্কুলে ফিরে আসে না।” অন্যদিকে, বাল্যবিয়ের আয়োজন বা অনুষ্ঠান চলাকালীন মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হলে পরিবারটি সামাজিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেয়ে শিশুটিও আতংকিত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। তাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এমন সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে অভিভাবকরাই বাল্য বিয়ের চিন্তা থেকে মানসিকভাবে বিরত থাকবে। তবে, বাল্যবিবাহ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হতে পারে শিশুকাল থেকেই-এমনটি মনে করেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “সদর উপজেলার ৫ম-১০ম শ্রেণির ২২ হাজার ৫শ’ ১৯জন মেয়ে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের ‘বাল্যবিবাহকে লালকার্ড’ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ১৭৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী শিশু-কিশোর রেড কার্ড টিম গঠন করা হয়েছে। যার সদস্য সংখ্যা ২ হাজার ৪শ’ ৯২জন। এখন কোন মেয়ে শিশুর বাল্যবিবাহের আয়োজন বা কথা হলে রেডকার্ড টিমের সদস্যরাই তা প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে। ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছে হেল্পলাইনের নম্বরে। এতে বাল্যবিয়ের পরিকল্পনা/আয়োজন সম্পর্কে প্রশাসন অধিক হারে এবং সময়মত তথ্য পাবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। সাতক্ষীরা জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জোৎ¯œা দত্ত জানান, বাল্যবিবাহ সমাজের অভিশাপ। ইভটিজিং, দারিদ্র্যসহ নানা কারণে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারছেন না মানুষ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের মাধ্যমে শিশুদের যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। এতে তারা মানবসম্পদে পরিণত হবে। আর্থিকভাবে ক্ষমতায়িত হবে। এজন্য প্রশাসনিক তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিকভাবে সোচ্চার হতে হবে।