একজন সংগ্রামী নারী জয়ন্তী রানী
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
জয়ন্তী রানী দাস প্রায় ৩১ বছর ধরে নেত্রকোনা রেল কলনীতে সরকারি খাস জমিতে বসবাস করছেন। ৫৭ বছর বয়সী জয়ন্তী রানী ৮৮ সালে মাত্র এক মাসের সন্তান ও মা বাবা হারানো ভাইকে নিয়ে নেত্রকোনা বড় স্টেশনে এসে দাঁড়ান। নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলা বড়কাপন ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামের মেয়ে তিনি। বিয়ের পর পরই মা ও বাবাকে হারান তিনি। তাঁর দরিদ্র স্বামী অন্যের জমিতে চাষ করেন; কোন কোন সময় তিনি মাছও ধরেন। তাঁর স্বামী যা আয় করতেন তা দিয়েই মোটামুটি তাদের সংসার চলতো। তাই জয়ন্তী রানী নিজের একমাত্র ভাইকে নিজের কাছে এনে রাখেন। তবে বিয়ের ৩ বছরের মাথায় হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী মারা যান। এরপর থেকে জয়ন্তী রানীর জীবন সংগ্রাম সূত্রপাত হয়।
জয়ন্তী রানী দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাই নিজের এ চরম বিপদের দিনে নিজের মেয়ে ও ছোট ভাইয়ের মুখ চেয়ে নিজের মনকে শান্ত করেন। তিনি স্বামীর ভিটেতে কোনরকম চাষবাদ করেন। তিনি ভিটে আকড়ে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন যেখানে তিনি চাষবাস করে ভালো থাকতে পারেন। কিন্তু অভাগা মানুষের অভাব বুঝি শেষ হয় না; দুঃখী মানুষে দুঃখ শেষ হয় না! ১৯৮৮ সালের বন্যায় ভেসে যায় তাঁর ধানী জমি, ভিটে মাটি ও সহায় সম্বল।
নিজের এক মাসের বয়সী শিশু কন্যা এবং ৬ বছরের ভাইকে নিয়ে অসহায় জয়ন্তী রানী বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই চলে আসেন ঠিকানাহীন মানুষে ঠিকানায় (নেত্রকোনা রেলকোলনী)! নেত্রকোনা রেল স্টেশনের বসবাসরত তাঁর মত দরিদ্র পরিবারগুলোর ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নেন। প্রথম কয়েকদিন অন্যের কাছ থেকে চেয়ে খেয়ে কাটালেও, অন্যের সহায়তায় চলা তার কাছে খুবই খারাপ লাগত। তাই অন্যর বাড়িতে রান্নার কাজ শুরু করেন খুব সামান্য বেতনে। কলনীতে ছোট একটি চালা ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। জয়ন্তী রানীর লেখাপড়া জানা নেই, নেই কোন কাজের অভিজ্ঞতা! কাজ খুঁজতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন শিক্ষার কি প্রয়োজন! একটু বিদ্যা থাকলে মানুষ এক চোখে দেখে আবার বিদ্যাহীন মানুষে কোথাও গিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন হাজার কষ্ট হলেও নিজের মেয়ে ও ভাইকে পড়াবেন।
জয়ন্তী রানী অন্যের বাড়ি কাজ করে যা রোজগার করতেন তা দিয়ে কোন রকম আধ পেটা খেয়ে কিছু টাকা জমিয়ে রাখতেন মেয়ে এবং ভাইকে লেখাপড়া করানোর জন্য। ভাইকে ভর্তি করিয়ে দেন কলনী থেকে কিছু দূরের স্কুলে। তাঁর মেয়ে ৫ বছর বয়স থেকেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে অন্যর বাড়িতে কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসারের খরচ চালানো কষ্টকর ছিল। তাই সন্তান ও ভাইয়ের পড়ার খরচ চালাতেই স্বাধীনভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন।
রেল কলনীতে অনেক পরিবার আছে, যারা নোয়াখালি, বিক্রমপুর থেকে এসে বাসা ভাড়া নিয়ে কলনীতে বসবাস করেন। তারা অধিকাংশই ফেরিওয়ালা। তাদের দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজেও ফেরি করে কসমেটিক্স বিক্রয় করবেন। সেই চিন্তা থেকে ফেরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কসমেটিক্সের বিভিন্ন জিনি বিক্রয় করতে থাকেন তিনি। খুব সামান্য মূলধন দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চুলের বিনিময়ে চুড়ি, টিপ, কাজল, নেলপলিশ ইত্যাদি জিনিস বিক্রয় করে নিজ সংসার চালান তিনি। এভাবে প্রতিদিনে তিনি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা রোজগার করেন। তাঁর ভাইকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর পর ঢাকায় পাঠান কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। নিজের মেয়েকে পাশ করান এসএসসি।
একজন বিধবা, ভাসমান অসহায় দরিদ্র নারী চলার পথে হাজার বাধা, অনিরাপত্তার মধ্যে নিজের পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ৩১ বছর ধরে। রেল কলনীর মত অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ পরিবেশে থেকেও যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে ছিলেন তা রেল কলনীর অন্যান্য দলিত পরিবারেও প্রভাব পড়েছে। নেত্রকোনার রেলকোলনীর অনেক ছেলেমেয়ে এখন স্কুলে পড়াশুনা করছে।
জয়ন্তী রানীর এ সংগ্রামী জীবন এলাকার দরিদ্র নারীদের পরিশ্রম করে জীবন চালানোর মনোভাব সৃষ্টি করছে। এলাকার অনেক দরিদ্র নারী তার কাছে পরামর্শ নিয়ে বিভিন্ন আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে যুক্ত হয়েছেন। যার ফলে কলনীপাড়ার অনেক পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের শিক্ষা গ্রহণেরও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে যেসব নারী বাধা পার হয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকতে চান জয়ন্তী রানী তাদের মধ্যে একজন।