সৃষ্টিশীলতায় নারী
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
মানুষের কাজের প্রতি আগ্রহ থাকলে সেটা শখে পরিণত হয়। এবং এই শখ এক সময় তাঁকে অনেকের মাঝে ব্যতিক্রমী মানুষ হিসেবে পরিচিত করে তুলে। তেমনই একজন নারী দরুণ হাসামপুর গ্রামের লাকী আক্তার। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি ঝোঁক ছিল। যেখানেই নতুন কিছু দেখতে পেতেন, নিজের মতো করে শেখার চেষ্টা করতেন।
শেখার অভ্যাসটা শুরু হয় নিজের পরিবার থেকেই। তাঁর মা যখন বাঁশ, বেত দিয়ে গৃহস্থালীর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করতেন তখন মায়ের পাশে বসে থাকতেন। ফাঁকে ফাঁকে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে তৈরির পদ্ধতিও জেনে নিতেন। এভাবেই লাকী খলই, চালুন, কুলা ইত্যাদি তৈরী করতে শিখেছেন।
তারপর আশপাশের প্রতিবেশিদের কাছে শিখেছেন মাটি দিয়ে চুলা তৈরী করতে। লেখাপড়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে তিনি সারাদিন মাটির চুলা, বাঁশের খলই এগুলো তৈরীতেই ব্যস্ত থাকতেন। সমবয়সীরা যখন গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, খেলাধূলা করে সময় কাটাতো সেই সময়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরী করা তাঁর শখে পরিণত হয়। যেকোনো জিনিস একবার তৈরী করা দেখলে তিনি শিখে ফেলতে পারেন।
এভাবেই চলতে থাকে তার দৈনন্দিন জীবন। বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যখন সে কলেজে ভর্তি হয় তখন সুযোগ আসে কাপড় সেলাইয়ের কাজ শেখার। নিজের আগ্রহে লাকী আক্তার পাশর্^বর্তী গ্রামের একজন দর্জির কাছে যাওয়া শুরু করেন। সেখানে মেয়েদের বিভিন্ন ধরণের পোশাক তৈরীর জন্য কাপড় কাটা ও সেলাইয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। আস্তে আস্তে তিনি সব ধরণের পোশাক তৈরী করা শিখে ফেলেন। সেলাইয়ে যখন তিনি সিদ্ধহস্ত হয়ে যান তখন মেয়ের আগ্রহ দেখে তার বাবা একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন। এরপর থেকে তিনি নিজের ও প্রতিবেশিদের কাপড় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন।
কাপড় সেলাইয়ের কাজ শেখার পর বিভিন্ন ধরণের দেয়ালচিত্র তৈরী করার প্রতি তার আগ্রহ জন্মায় । ডিমের খোসা, মসুর ডাল, ম্যাচের কাঠি, লাউবীজ ইত্যাদি দিয়ে কাপড়ের মধ্যে তৈরী করেন বিভিন্ন নকশার দেয়াল চিত্র। কাপড়ে আঠার সাহায্যে ঐসমস্ত উপকরণ লাগিয়ে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তুলেন।
বাড়ির অব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ যেমন মোটা কাগজের বাক্স, রঙিন কাপড় বা টিস্যু ব্যাগ ইত্যাদি ফেলে না দিয়ে তিনি এগুলোকেও কাজে লাগাতে শুরু করেন। বাজার থেকে আনা টিস্যু ব্যাগ দিয়ে তিনি পাপোশ তৈরী করেন। মোটা কাগজ বা বিস্কিটের বক্স, রঙিন কাপড় দিয়ে অনায়াসেই তৈরী করেন প্রয়োজনীয় উপকরণ বা সাজগোজের জিনিস রাখার বাক্স।
পাশাপাশি তিনি পড়ালেখাও চালিয়ে যান। নেত্রকোণা শহরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বি.এ পাশ করেন। এরই মাঝে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে আরো বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে তার সেলাই ও হস্তশিল্পের কাজ। বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরী করে তিনি নিজের ঘর সাজানোর ছাড়াও আত্মীয়দের উপহার হিসেবে দিতেন।
লাকী আক্তারের এ ধরণের কাজ আস্তে আস্তে তার নিজ গ্রামেও পরিচিতি পেতে থাকে। অনেকেই তার কাছে বিভিন্ন শৌখিন জিনিস তৈরী করার ফরমায়েশ নিয়ে আসতে থাকে। তিনিও নামমাত্র মজুরীর বিনিময়ে এসব তৈরী করে দিতেন। নিজের চর্চার পাশাপাশি কিছু উপার্জনও হয়।
যে প্রতিষ্ঠানে তিনি যুক্ত ছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাকী আক্তার আর কোনো চাকুরীতে যুক্ত হননি। চাকুরী ছেড়ে দিলেও তিনি তার শখের কাজ ছাড়েননি। নিজের ভালো লাগা থেকে শেখা কাজ এখন তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।
একমাত্র সন্তানের দেখাশুনা ও সংসারের কাজ সামলে তিনি কাপড় সেলাই ও হস্তশিল্পের কাজ করেন। এছাড়াও অবসর সময়ে হাঁস, মুরগী, ছাগল পালন, বসতভিটায় সব্জী চাষ একাজগুলোও তিনি করে থাকেন। লাকী আক্তারের স্বামী একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সংসারে অভাব না থাকলেও লাকী আক্তার উপার্জনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। এই কাজের ফলে তার স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে। নিজের গ্রামে এখন অনেকেই তাকে সম্মান করে। অনেক কিশোরী, নারী তার কাছে সেলাই শিখতে আসে। তিনিও সাধ্যমতো অন্যদের শিখিয়ে দেন।
নিজের উপার্জনের টাকায় তিনি তার পছন্দমতো কেনাকাটা করার পাশাপাশি সঞ্চয়ও করেন। ভবিষ্যতে তিনি একটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরী করতে চান।
বিভিন্ন ধরণের সেলাই ও হস্তশিল্পের কাজ শেখার জন্য কখনো লাকীর পরিবার থেকে বাধা আসেনি। তার মা, বাবা এমনকি স্বামীও এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন। একজন নারী যখন পরিবারের সমর্থন পায় তখন তার কাজ এমনিতেই সহজ হয়ে যায়।
বহু বছর আগে থেকেই আমাদের নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি শৌখিন কাজের সাথে যুক্ত। অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা পরিবারের অর্থনৈতিক কর্মকা-েও ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁদের এই ধরণের কাজে একদিকে যেমন সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ পায় অন্যদিকে তেমনি পরিবারে ব্যয় সাশ্রয়ী ভূমিকাও রাখে।