খাদ্য পুষ্টির উৎস হলো আমাদের বাড়ি
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিটি পরিবারে এক সময় প্রায় নানান ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য ভরপুর ছিলো। প্রতিটা বাড়ি বা পরিবারের বাইরের দৃশ্য দেখলে বোঝা যেতো কতই না সম্পদ ছিলো। বাড়িতে চাষ হতো হরেক ধরনের সবজি, মসলা, ডাল। পাওযা যেতো নানান ধরনের বনজ ও ফলজ গাছ। বাড়ির আশেপাশে আনাচে- কানাচে জন্ম নিতো নানান ধরনের অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। পুকুরে, ডোবায়, বাড়ির নিচে বেড় ও বিল পুকুরে নানান ধরনের স্থানীয় মাছ। মাঠে চাষ হতো নানান ধরনের স্থানীয় ধান। বাড়িতে পালন হতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া, মহিস, কবুতর, বিভিন্ন ধরনরে পাখি। বাড়িগুলো যেমন ছিলো সবুজে মোড়ানো তেমনি সেগুলো ছিলো নানান ধরনের খাদ্য ও পুষ্টিতে ভরপুর। কালের পরিক্রমায সেগুলো যেনো আজ অধিকাংশই শুধু স্মৃতিতে মোড়ানো গল্প। উপকূলীয় এলাকায় ঘন ঘন প্রাকৃতিত দুর্যোগ, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ এবং বাণিজ্যিক হারে কৃষি ফসল উৎপাদন সহ জন্য সব কিছু বিলিন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নিজস্ব জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে গ্রাম বাংলা অসংখ্য নারী এখন প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে খাদ্য পুষ্টির উৎস টিকিয়ে রেখে চলেছে। তেমনি একজন নারী হলো শ্যামনগর উপজেলার শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের কালমেঘা গ্রামের কৃষাণী অদিতি রানী।
অদিতি রানীর মোট জমি প্রায় সাড়ে ৪ বিঘা। তার মধ্যে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। আর বাকি ১ বিঘা বসতভিটা যেখানে বছরব্যাপী নানান ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন। বাড়িতে বর্তমান মৌসুমের জন্য লাউ, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, বেগুন, ঢেড়স, পুইশাক, শসা, উচ্চে, তরুল, শিম, কচুরমুখি, কচু, হেলাঞ্চ, কলমিশাক, বউটুনি, পেপুল, আদা, হলুদ, ও ঝাল লাগিয়েছেন। বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছ আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, কলা, পেঁপে, ডালিম, ছবেদা, আনারস, পেয়ারা, কাট বাদাম, বাতাবি লেবু, আমড়া, কদবেল, বেলসহ নানান ধরনের গাছ। কাঠ জাতীয় গাছ আছে মেহগনি, আকাশমনি, শিশু গাছ, খৈ, বাবলা ইত্যাদি। পুকুরে আছে নানান ধরনের মাছ। এছাড়াও একটি ঘের আছে যেখানে নোনা পানির বিভিন্ন মাছ ও হয়। এগুলোর পাশাপাশি বাড়িতে ৪টি গরু, ৮টি ছাগল, ১৫টি হাঁস, ১৩টি মুরগি আছে, যা দিয়ে সংসারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে বড় একটি অংশ আয় হয়।
অদিতি রানী বলেন, ‘আমার বাড়িটি ছোট জায়গাও কম কিন্তু সব জায়গা আমি ব্যবহার করি। এমন কোন ফাঁকা জায়গা পড়ে নেই আমার । সব জায়গায় কম বেশি করে নানান ধরনের ফসল আছে। সব সময় কোন না কোন কিছু আমার বাড়িতে থাকে। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। পরিবারের জন্য বাজার থেকে তেল ছাড়া তেমন কিছু কেনা লাগে না। বাড়িতে যে ফসল উৎপাদন হয় তা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে ভালো একটি অংশ বিক্রি করতে পারি। একটি পরিবারের যত রকম পুষ্টি দরকার আমি মনে করি তার সব কিছু আমার বাড়িতে আছে। সবজি আছে, ফল আছে, অচাষকৃত উদ্ভিদ আছে, হাঁস-মুরগি আছে, গরুর দুধ আছে, পুকুর ও ঘেরে নানান ধরনের মাছ আছে। মাঠের জমিতে ধান, ডাল, সরিষা ও গম চাষ করি। সব কিছু মিলিয়ে আমার বাড়ি একটি পুষ্টি বাড়ি। আর আমাদের এ বাড়িই হলো খাদ্য ও পুষ্টির উৎস।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রতিবছর যে সব ফসল চাষাবাদ করি তার বীজ সংরক্ষণ রাখি। প্রতি মৌসুমের ১৫-২০ জনের মাঝে বীজ বিতরণ করি। এই করোনার সময সপ্তাহে প্রায় ২-৫ জনের বিভিন্ন ধরনের সবজি দিয়ে সহাযতা করছি। এছাড়াও এবছর অনাবৃষ্টির কারণে জলের সমস্যা থাকায় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সবজি চাষ করতে পারিনি। কিন্তু আমার ক্ষেতে সবসময সবজি ছিলো। পাশে সুপেয় পানির ফিল্টার থাকায় তাদের কলস ধোওয়া জল আমি ড্রেন করে আমার সবজি ক্ষেতের মধ্যে নিয়েছিলাম। এছাড়াও বারসিক সহাযতায় যে পুষ্টি ভিত্তিক ‘পুষ্টি ব্যাংক’ শত বাড়ি তৈরির কাজ চলমান রয়েছে সেখানে আমার বাড়িটিই যুক্ত হয়েছে। বারসিক থেকে শত বাড়ি উন্নয়নে ধারাবাহিক সহায়তা ও যোগাযোগ চলমান রয়েছে।’
অদিতি রানীর মতো যেসব নারীরা নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাদের কাজকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আরো গতিশীল করা জরুরি।