নবান্নে মাতলো কাইলাটির জনগোষ্ঠী

নবান্নে মাতলো কাইলাটির জনগোষ্ঠী

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

এখন অগ্রহায়ণ মাস। অগ্রহায়ণ মাস গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে কৃষক-কৃষাণীদের জন্য এক বিশেষ মাস। অগ্রহায়ণ মাসে গ্রাম বাংলার মাঠ ভরা পাকা ধানের সমারোহ। গ্রামের বাতাস পাকা ধানের মূহু মূহু গন্ধে ভরে উঠে। মাঠ ভরা পাকা সোনালি ধানে নয়ন ভরে যায়। কৃষক-কৃষাণীদের ব্যস্ত সময় কাটছে মাঠের ধান কাটা, মাড়াই করা ও ধান শুকানোর কাজে। আর কিছুদিন পরই গ্রামে গঞ্জে ধান কাটার ধুম লেগে যাবে, কৃষকদের আয়েসী সময় কাটানোর কোন ফুসরত থাকবেনা। চলতি বছর আবহাওয়া অনূকূল হওয়ায় ধানের খুব ভালো ফলন হয়েছে, তাই কৃষক-কৃষাণীদের মুখ ভরা হাসি, মনে সীমাহীন আনন্দ। আগ্রহায়ণে ঘরে তোলার পর গ্রামীণ কৃষক-কৃষাণীরা মেতে উঠে নবান্ন উৎসবে। কৃষাণীরা নানান জাতের, নানান স্বাদ ও গন্ধের চাল দিয়ে তৈরি করে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী বাহারী পিঠা, যেমন-পুলি পিঠা, পায়েস, ফুল, ভাপা, চিতই, মেরা পিটা, দুধ চিতই, মুড়ি, চাপ খৈ ইত্যাদি। শীতকালে রাস্তার মোড়ে ভাপা, চিতই ও মেরা পিঠা তৈরি করে গরম গরম পিঠার পসরা সাজিয়ে বসে দরিদ্র গ্রামীণ নারীরা, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসবকে।

20181112_114206
নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়ন পরিষদ, বালি যুব সংগঠন এবং ফচিকা অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব। কৃষক আব্দুর রহমান এর জমিতে ধান কাটার মধ্য দিয়ে নবান্ন উসব অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কাইলাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে আয়োজন করা হয় বাহারী পিঠার প্রদর্শনী, আলোচনা সভা ও গ্রামীণ খেলাধূলা প্রতিযোগিতা।

20181104_112356
নবান্ন উৎসব উপলক্ষে আলোচনা সভায় ইউনিয়ন পরিষদের ‘খেলাধূলা ও সংস্কৃতি স্ট্যান্ডিং কমিটি’র সভানেত্রী নুরজাহান আক্তার বলেন,‘নবান্ন মানেই অগ্রহায়ণ মাসের নতুন ধান ঘরে তোলা, নতুন ধানের চালের পিঠা তৈরি এবং সকলে মিলে আনন্দ ভরে খাওয়া ও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মেতে ওঠা। আর নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্যমনি গ্রামীণ নারীরা। গ্রামীণ নারীরা সুখ-দুঃখের গল্প-গুজব করে, গান গেয়ে এবং রাতভর চালের গুড়ি কুটে বাহারী পিঠা তৈরী করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভোর হলে গ্রামের সকলে মহানন্দে গান গেয়ে ও হাসি-ঠাট্টা করে পরস্পরকে পিঠা খাইয়ে দিত এবং সকলে খুব আনন্দ করত। কিন্তু বর্তমানে গ্রামীণ এই সংস্কৃতিগুলো হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এখন নবান্ন উৎসব করা হয় শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। গ্রামের মানুষের মধ্যে আগের মত পারস্পারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় নেই, নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে সকলে ব্যস্ত।’

20181112_134951
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি (সদস্য) খোকন মিয়া বলেন, ‘এখন সবাই হাইব্রিড ধান চাষ করে, তাই ধানের মৌ মৌ গন্ধ নাই। তবু অগ্রহায়ণ মাস এলেই আমাদের মনে হয় যেন নবান্ন উৎসব। নবান্ন মানেই বাংলার গ্রামে গ্রামে নতুন ধানের পিঠা, নতুন ধানের পায়েস তৈরির হিড়িক পরা। কিন্তু আগের তুলনায় এসব একেবারেই কমে যাচ্ছে, তাই আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিগুলো টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবটি তাই সরকারীভাবে আয়োজন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিগত বছরও আমরা উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে নবান্ন উৎসব করেছি।’

20181112_134840
গ্রামের প্রবীণ কৃষক আব্দুল আলিম বলেন, ‘বারসিক’র সহযোগিতায় ও যুব সংগঠনের উদ্যোগে আমরা এবছর নবান্ন উৎসব আয়োজন করতে পারছি। আমি আজ গ্রামীণ খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করতে পারায় আমার খুব ভালো লাগছে। অনুষ্ঠানে এসে অনেক দিন পর আমি অনেক জাতের পিঠা এক সাথে দেখলাম। আগে আমার মা-চাচীরা সকলে মিলে বিভিন্ন জাতের অনেক পিঠা বানাইত, বেয়াই-বেয়াইন অন্যান্য বাড়িতে পিটা নিয়ে যাইতাম। এখন আর সেই মিল মহব্বত গ্রামের মানুষের মধ্যে দেহা যায় না।’

20181112_140431
আলোচনা পর্ব শেষে উৎসবে অংশগ্রহণকারী নারী, শিশু, কিশোর-কিশোরী ও প্রবীণদের জন্য বিভিন্ন ধরণের গ্রামীণ খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ খেলাধুলা শেষে অংশগ্রহণকারীরা গ্রামীণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকলকে মুগ্ধ করে। অনুষ্ঠান শেষে গ্রামীণ খেলাধুলা ও পিঠার স্টল প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়।

happy wheels 2

Comments