প্রবীণবান্ধব সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল ও মারুফ হোসেন মিলন
আমরা প্রবীণ বা বার্ধক্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। এটা ভুল ধারণা। বার্ধক্য সম্পর্কে একমাত্র প্রবীণ ব্যক্তিরাই জানেন, আর কেউ নন। বৃদ্ধ মা- বাবাসহ পরিবারের অন্যান্য প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে আমরা যা জেনেছি তা কোন বই পত্রে নেই। কিন্তু সেটা আমাদের সম্পদ। যা আমাদের ভবিষ্যৎ পথ চলার আলোর দিশা সেটাকে বাতি করে নিয়ে হয় আমাদের আগামীর পথ চলা। প্রবীণ ব্যক্তির সমস্যা বুঝতে হলে আগেই প্রবীণ হতে হবে তাহলেই বুঝতে পারবো তাঁদের কি সমস্যা কি চান তাঁরা। আমরা অনেকেই মনে করি এবং আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে পরিবারে রেখে প্রবীনদের দেখভাল করাই আমাদের রীতি। কিন্তু বাস্তবে নানা কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের প্রবীণরা আজ ভালো নেই। তারা এখন নিজের বাড়িতেই বিভিন্ন নির্যাতন ও দূর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই প্রবীণ সংখ্যা বাড়ছে তার সাথে সমাজে প্রবীনদের প্রতি দূর্ব্যবহার ও নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। এটা এখন একটি বৈশি^ক সামাজিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো প্রবীণদের নির্যাতিত ও নিপিড়িত এ বিষয়টিকে আমাদের সমাজের অন্যরা মামুলি, গুরুত্বহীন, এমনকি নিয়তির স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেন। কিন্তু সেটা তো আমাদের মতো মানুষদের তৈরি। আমরা যদি নিজেদেরকে প্রবীণদের জায়গায় নিয়ে বুঝার চেষ্টা করি তাহলেও প্রবীণ সমস্যা দুর করা সম্ভব। অন্যথায় নয়। পিতা মাতার সেবা করা প্রত্যেক সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। পরিবারের সকলকে নিয়ে যৌথ পরিবারে মানুষের বসবাস ছিল পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সে প্রথা পরিবর্তন হচ্ছে। এখন খুবই কমই পাওয়া যায় এমন যৌথ পরিবার। সন্তানরা ভুলে যাচ্ছে মা-বাবার মায়ার বন্ধন। দেশের এমন পরিস্তিতি অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার পিতামাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩ পাস করে। এ আইনে পিতামাতা, দাদা-দাদি এবং নানা-নানির ভরণ-পোষণ করা সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব্। অন্যথায় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে পিতামাতার ভরণ পোষণ আইন সম্পর্কে, এবং পিতার মাতার উপর সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। সমাজের প্রত্যেক প্রবীণ ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রবীণদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া।
প্রবীণরা যে নবীনদের পথ প্রদর্শক নবীনদেরকে তা অনুধাবন করতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবীণবান্ধব সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার নিমিত্তে গত ২০ নভেম্বর বাদঘাটা আইসিএম কৃষি ক্লাব প্রাঙ্গনে বারসিকের সহযোগিতায় সুন্দরবন স্টুডেস্ট সলিডারিটি টিম ও বাদঘাটা আইসিএম কৃষি ক্লাবের আয়োজনে “প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায় জারি গান এবং প্রবীণ সম্মাননা” অনুষ্টিত হয়। সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত জারি গান পরিবেশন করেন উপকুলীয় জারি গানের শিল্পী দাউত বয়াতিসহ তার শিল্পী গোষ্ঠী এবং বারসিকের বিধান মধু।
জারি গান পরবর্তীতে উপকূলীয় এলাকায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ৭ জনকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের সভাপতি মারুফ হোসেন মিলন। সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন, শ্যামনগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবর রহমান, বাদঘাটা গ্রামের দুদুবার ইউপি সদস্যা নির্বাচিত কৃষাণী এবং গ্রাম পাঠশালার শিক্ষিকা গীতা রানী গায়েন, বাদঘাটা গ্রামের আমিন অরবিন্দু মন্ডল, গোপালপুর গ্রামের কাঠ মিস্ত্রি জগদিশ মন্ডল, সোনামুগারী গ্রামের গ্রাম্য কবিরাজ ও জেলেনি পার্রবতী ধীবর, সোনামুগারী গ্রামের জেলে পতিরাম ধীবর,বাদঘাটা গ্রামের নাট্যশিল্পি রনজিৎ মন্ডল।
সম্মাননা হাতে পেয়ে বাদঘাটা গ্রামের প্রবীণ আমিন অরবিন্দু মন্ডল বলেন, ‘আজকে যারা এ কর্মসূচি আয়োজন করেছে তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের সমাজে মানুষেরা প্রবীণদেরকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। আমরা সমাজের জন্য যে এত ভূমিকা রেখেছি তা আর কজন মনে রেখেছে। আমাদের মতো প্রবীণদের যে আজকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে যে সম্মান দেখানো হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে আমাদের শেষ বিদায়ের বেলায় এক অনাবিল শান্তি পেলাম। আমাদের নিয়ে যে এখনো মানুষ ভাবে, সম্মান করে তা আজকে বুঝতে পারলাম। যে প্রবীণদের পাশে কেউনা কেউ আছে। তাদের সমস্যার কথা বুঝবে। আমাদের সমাজটা যদি প্রবীন বান্ধব হতো তাহলেও কতই উন্নতি হতো আমাদের।’