আজ বিশ্ব প্রবীণ দিবস : প্রবীণদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

আজ পহেলা অক্টোবর। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে দিবসটি। কেমন আছেন আমাদের প্রবীণেরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় চাটমোহরের তিন প্রবীণ নারী পুরুষের সাথে।

Asia khatun
২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুরের একটু পূর্বে পাবনার চাটমোহর-মান্নাননগর সড়কের কুজোর মোড় এর পশ্চিম পাশের বিলে ষাট বছর বয়সী আছিয়া খাতুন পানির মধ্যে নেমে শাপলার কন্দ শালুক তুলছিলেন। দূর থেকে ডাকতেই শালুক তুলতে তুলতে বিলের পানি ও জলজ উদ্ভিদ মাড়িয়ে এগিয়ে আসেন তিনি। আছিয়া বলেন, “চাটমোহরের নিমাইচড়া ইউনিয়নের চিনাভাতকুর গ্রামে আমার বাড়ি। বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ স্বামী রমজান আলী কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। আগে তিনি মসজিদে ইমামতি, জমি পরিমাপের কাজ করতেন। কখনো কখনো নিচ ক্লাসের ছাত্র পড়াতেন। বেশ কয়েক বছর যাবত ঘরে পরে আছেন তিনি। এখন আর এসব কাজ করতে পারেন না। দুই ছেলে এক মেয়ে আমার। মেয়েটিকে রামচন্দ্রপুর গ্রামে বিয়ে দিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “ছেলে আজাদ হোসেন একটি মসজিদে ইমামতি করে। আরেক ছেলে মাজেদ ঢাকায় গার্মেন্টস এ কাজ করে। স্বস্ত্রীক ঢাকায় থাকে সে। দুই ছেলেরই পৃথক সংসার। আমার বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ স্বামী ও আমাকে দেখাশুনা করার মত ইচ্ছা ও সামর্থ কোনটাই নেই তাদের। স্বামী তার নামে থাকা বাড়ির দশকাঠা জমি বেশ আগেই দুই ছেলের নামে রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন। সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। খুব কষ্টেই দিনাতিপাত করতে হয়। ইচ্ছে করেই খাওয়ার জন্য শালুক তুলতে বিলে এসেছি। শালুক পানিতে সিদ্ধ করে ছিলে খাওয়া যায়।”

sreemoti sorder
২৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুরে চাটমোহর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সের পাশে বড়াল নদীর পাড়ের নিমতলায় দেখা মেলে আদিবাসী শ্রীমতি সরদারের সাথে। মলিন মুখ। হাতে ভিক্ষের ঝুলি। পঁয়ষট্রি বছরের মতো বয়স হবে শ্রীমতির। আলাপকালে শ্রীমতি বলেন, “দেশ স্বাধীনের সময় ছোট ছিলাম। বাবার বাড়ি ছিল জয়পুর হাটের হিলি পাঁচবিবি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর বারো তেরো বছর বয়সে বাবা আমায় চাটমোহরের আদিবাসী (বুন্যা) ভুলু সরদারের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। চলে আসি চাটমোহরে। আমার স্বামী চৌকিদার ছিল। একটা মেয়ে হয় আমাদের। নাম রাখি স্বরস্বতী। বড় বন্যার বছর আমার স্বামী মারা যায়। কষ্টে শিষ্টে লালন পালন করি স্বরস্বতীকে। বড় করে রাম নামক এক যুবকের সাথে বিয়ে দেই। একটা মেয়েও হয় ওদের। কিন্তু রাম স্বরস্বতীকে ভাত কাপড় দেয় না। কোন খোঁজ খবর ও নেয় না।” তিনি আরও বলেন, “এখন আমি, স্বরস্বতী ও তার মেয়ে এ তিনজন একত্রে আছি। স্বরস্বতী পৌরসভায় ঝাঁড়–দাড়ের কাজ করে। সকালে কাজ। সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতন পায়। ৫শ’ টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়। এছাড়াও দৈনিক চাল ডাল বাজার বাবদ অন্তত দুইশ’ টাকা সংসার খরচ। অসুখ বিসুখ কাপড় চোপর আর কত খরচ। পৌরসভার কাজ শেষে মেয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে দেয়। কখনো গোবর খুটে। মেয়ে বাড়ি ফিরলে দুপুরের আগে আমি বেড়িয়ে পড়ি ভিক্ষের ঝুলি হাতে। দিন বিশ-ত্রিশ টাকা পাই। আগে শরীরে জোর ছিল। তখন ধান লাগানো নিড়ানোসহ বিভিন্ন ধরণের কৃষি কাজ করতাম। এখন শরীরে পারে না। তাছাড়া বৃদ্ধাদের মানুষ আর কাজেও নেয় না। কিন্তু চলতে তো হবে। মেয়ের যৎসামান্য উপার্জন, আমার সামান্য বিধবা ভাতা আর চেয়ে চিন্তে যা পাই তা দিয়ে কোন মতে চলে যাচ্ছে তিন পেট।”

Abdul kader

২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুরের একটু পর পর চাটমোহর বালুচর খেলার মাঠের পূর্ব উত্তর কোনে কলা ভর্তি ঝাঁকা (ঢাকি) মাথায় নিয়ে হাটতে-হাটতে হাপাতে-হাপাতে আবুলের মুদি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ান চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের বোঁথর গ্রামের কলা বিক্রেতা আব্দুল কাদের (৮০)। ১৫ বছর যাবত তিনি কলার ব্যবসা করে আসছেন বলে জানান। আব্দুল কাদের বলেন, “বড় ছেলে রেজাউল ডাব বিক্রি করেন। মেয়ে রেজেনা ও রাজিয়াকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি বেশ আগেই। ছোট ছেলে রফিকুল কাঁচা মালের ব্যবসা করে। মেয়েরা স্বামীর ঘরে সংসার করছে। আর ছেলেদের পৃথক সংসার। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে তারা আলাদা থাকে।” তিনি আরও বলেন, “যতক্ষণ শরীরে পারে ততক্ষণ কাজ করতে চাই। বসত বাড়ি আর এক বিঘা ফসলী জমি আছে নিজের। ফসল আবাদ করে পোষায় না। তাই কলার বাগান কিনি। কলা কেটে পাকিয়ে দোকানে দোকানে সরবরাহ করি। যা আয় হয় তা দিয়ে স্বামী স্ত্রী এ দুজনের সংসার চালাই।”

এটি একটি খন্ড চিত্র। এমন অনেক প্রবীণ ব্যক্তি আছেন যারা জীবন জীবিকার জন্য বৃদ্ধ বৃদ্ধা বয়সেও অমানসিক পরিশ্রম করতে বাধ্য হন। অনেক সন্তান আছেন যারা নিজেরা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করলেও ভূলে যান বৃদ্ধ বাবা বৃদ্ধা মায়ের কথা। কিন্তু একথা ভূলে গেলে চলবে না আজকে যারা শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী তারাই একদিন প্রবীণ হবো। তাই প্রবীণদের অবজ্ঞা নয় তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।

happy wheels 2

Comments