প্রবীণদের অভিজ্ঞতা নবীনদের জীবনে কাজে লাগাতে হবে
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
পহেলা অক্টোবর হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও জাতীয় প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্য দিয়ে দিনটি উদ্যাপিত হয়েছে গতকাল। জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, নেত্রকোনা জেলা শাখার আয়োজনে বারসিক, জেলা প্রেসক্লাব ও সাংস্কৃিতক সংগঠনের অংশগ্রহণে নেত্রকোনা জেলা পর্যায়ে র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে রচনা প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণী ও সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী দিবসটি উদ্যাপন করা হয়।
গতকাল মাননীয় সাংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান শেফালী (সংরক্ষিত মহিলা আসন-১৭) ও জেলা প্রশাসক জিয়া আহম্মদ সুমনের নেতৃত্বে এবং বিভিন্ন শ্রেণী, বয়স ও পেশার (উন্নয়ন কর্মী, গণমাধ্যম কর্মী, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষাবিদ, লেখক, কবি, ব্যবসায়ী) জেলা শিল্পকলা একাডেমী থেকে স্লোগানসহ একটি র্যালি আরম্ভ হয়ে জেলা সার্কিট হাউজে শেষ হয়। র্যালি শেষে সার্কিট হাউজ হল রুমে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, নেত্রকোনা জেলার সাধারণ সম্পাদক ছায়েদুর রহমান এর সঞ্চালনায় জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সভাপতি জেলা প্রশাসক জিয়া আহম্মদ সুমনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় সাংসদ সদস্য (সংরক্ষিত আসন-১৭) হাবিবা রহমান শেফালী। অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফখরুজ্জামান জুয়েল, জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আলাল উদ্দিন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান খান, মহিলা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান তুহিন আক্তার, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অবঃ অধ্যাপক মতিন্দ্র সরকার, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ আব্দুল হামিদ খান (জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা), নেত্রকোনা জেলা চেম্বারস এন্ড কমার্স এর সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ প্রমূখ।
প্রধান অতিথি মাননীয় সাংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান শেফালী সকলকে প্রবীণ দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের উচিত প্রবীণ নিবাস তৈরি না করে প্রতিটি পরিবার যেন নিজ নিজ ঘরকে প্রবীণদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তোলে।’ তিনি প্রবীণদের উদ্দেশে বলেন, ‘পরিবারে পুরুষ প্রবীণদের চেয়ে নারী প্রবীণরা বেশি অবহেলিত। তাদের অধিকারের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি পুরুষ প্রবীণদেরকে তাদের জীবদ্দশায় নারী প্রবীণদের জন্য স্থায়ী কিছু করে যেতে বলেন, যাতে স্বামীর অবর্তমানে তারা পরিবারে সম্মানের সাথে বসবাসকরতে পারে।
জেলা প্রশাসক জিয়া আহম্মদ সুমন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘প্রবীণদের অভিজ্ঞতা নবীনদের জীবনে কাজে লাগাতে হবে। আামাদের উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষাথীদেরকে প্রবীণ অধিকার বিষয়ে জানানো, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা সম্পর্কে জানানো। প্রবীণ দিবসের অনুষ্ঠানে শুধু প্রবীণ নয় নবীদের অংশগ্রহণও থাকতে হবে। কেননা নবীনদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে প্রবীণদের অধিকার সুনিশ্চিত হবে না। তাই প্রবীণ দিবস নবীন ও প্রবীণ উভয়ের অংশগ্রহণে উদ্যাপন করতে হবে।’
জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান অংশগ্রহণকারীদেরকে প্রবীণ দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে সকল নবীণদেরকে নিজ নিজ প্রবীণ পিতামাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানীদেরকে যতœ ও সেবা করার আহবান জানান। চেম্বারস এন্ড কমার্স এর সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তির কল্যাণে প্রযুক্তির ব্যবহারে ডুবে থাকে। সমাজ ও সংসারের কোন খোঁজ তারা রাখতে চায় না। অবশ্য এজন্য আমরা নিজেরাই দায়ী, কারণ আমরা তাদেরকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। ‘নেত্রকোনা শহরে প্রবীণদের বসে আড্ডা দেয়া, গল্প করা ও বিনোদনের জন্য স্থায়ী কোন কেন্দ্র নেই। ফলে প্রবীণরা কোথাও একত্রে বসতে পারেন না। একটি স্থায়ী জায়গা সরকার থেকে পাওয়া গেলে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের ফান্ড দিয়ে ঘর তৈরি করা যেত।” এক্ষেত্রে তিনি মাননীয় সাংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক মহোদয়ের দৃষ্ঠ আকর্ষণ করেন।
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস উপলক্ষে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরষ্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে পিতামাতার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালনের জন্য একজন নারী ও একজন পুরুষকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়াও দেশ ও সমাজের জন্য বিশেষ অবদানের জন্য বিশিষ্ট প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। বারসিক নেত্রকোনার উদ্যোগে বিভিন্ন ইস্যুতে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা, বিনামূল্যে ঔষধি চারা বিতরণ, আর্তমানবতার সেবা, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং ডেঙ্গু রোগ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রচারণায় অবদানের জন্য বৃক্ষ প্রেমী ও আর্তমানবতার সেবক কবিরাজ আব্দুল হামিদকে একটি হ্যান্ড মাইক প্রদান করা হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি স্থানিয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে জনপ্রিয় লোকগীত পরিবেশিত হয়। প্রবীণ পুরুষ ও নারী কবিগণ তাদের স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। প্রবীণ যাত্রাশিল্পীগণ যাত্রাপালা থেকে সংলাপ করে শোনান।
উল্লেখ্য যে, আলোচনা সভায় বক্তাগণ প্রবীণদের অবস্থাগত দিক থেকে দুই ভাগে ভাগ করেন ১. অস্বচ্ছল ও দরিদ্র প্রবীণ এবং ২. স্বচ্ছল ও সবল প্রবীণ। অস্বচ্ছল ও দুর্বল প্রবীণ বলতে যেসব প্রবীণ আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল, কাজ কর্ম করতে পারেন না এবং তাদের দেখার কেউ নেই বা থাকলেও দেখেন না তাদের এবং স্বচ্ছল ও সবল প্রবীণ বলতে যেসব প্রবীণরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল/অবস্থাশালী এবং শারীরিকভাবেও সক্ষম তাদের বোঝানো হয়েছে। যেসব প্রবীণরা স্বচ্ছল ও সক্ষম সেসব প্রবীণদেরকে অস্বচ্ছল প্রবীণদের স্বার্থে কিছু করার জন্য বক্তারা আহবান জানান।