প্রবীণ পেশা : ধানের বিনিময় পণ্য

রাজশাহী থেকে মো. জাহিদ আলী

প্রবীণরা সমাজে বোঝা নয় সম্পদস্বরূপ। প্রবীণকে ফেলে রেখো না, ফল না দিতে পারলেও ছায়া দিবে, সংস্কার দিবে প্রায়। এই কথাটি শুনেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন বয়স্ক মানুষের প্রতিচ্ছবি যিনি অন্তত তার জীবনদশায় ছয় দশক সময় পার করেছেন। কিন্তু সব পরিবারেই কি সকল প্রবীণদের সমান সুযোগ থাকে? যে পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসাবে একজন প্রবীণ মানুষ থাকে তার আবার কিসের এতো যত্নাদি। অসুখ যেন তাদের কাছে আসতে মানা। তেমনই দুই মানুষের সাথে প্রায়ই দেখা হয়, গোদাগাড়ীর গোগ্রাম ইউপির বিভিন্ন গ্রামে। একজন জয়দার আলী (৬৮)ও অন্যজন আমিনুল ইসলাম (৬৭)।

Aminul islam
দুই জনের মধ্যেই অনেক মিল আছে। দুইজনের বাড়ি গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নে। বিদিরপুর ও পিরিজপুর গ্রামে। দুইজনই পরিবারের প্রধান উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি, দুইজনই সাইকেল নিয়ে ফেরি করে পণ্যের বিনিময় মালামাল বিক্রি করেন। জয়দার আলীর চারটি সন্তান তিনটি মেয়ে ও একটি ছেলে, মেয়ে তিনটির বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়েটি সংসার না করতে পারার কারণে নিজের সংসারেই থাকেন। ছোট ছেলেটি এখন ডিগ্রি পড়ছেন। আমিনুল ইসলামের চারটি মেয়ে দুটির বিয়ে দিয়েছেন আর দুইটি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাসায় বসে আছে। লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারেন না। এখন ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দিবেন। এমন আর্থিক অবস্থা যাদের তাদেরকে কী বাড়িতে বসে থাকলে চলে। যৌবনে জয়দার আলী দিনমজুরের কাজ করলেও ৩৫ বছর যাবৎ ফ্লোরি (ডালের তৈরি বড়া, তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়), পিয়াজু, বিক্রি করছেন। আমিনুল ইসলাম দিন মজুরের কাজ করলেও ৪ বছর ধরে তিলের খাজা বিক্রির কাজ করেন।

Joider ali 2
জয়দার আলীর বড়া,পিয়াজু তৈরির কারিগর হিসাবে কাজ করেন তার স্ত্রী ও মেয়ে। আর আমিনুল ইসলাম প্রতি সপ্তাহে রাজশাহী থেকে খাজা কিনে আনেন। বিক্রি করনে মাটিাকাটা ইউপির প্রেততলী, বসন্তপুর, ধাতমা, উছড়াকান্দর, বড়শীপাড়া, বিড়ইল, গোগ্রাম হাট পাড়ায়। প্রতিদিনই সাইকেল চালিয়ে দুইজন ৬ থেকে ৭টি গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাদের পণ্য বিক্রি করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাদের পন্য বিক্রি করেন। এতে টাকার অংকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পেলেও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ১০ কেজি থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত ধান পেয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে জয়দার আলী জাানন, “আমার বেশিভাগ ক্রেতা গ্রামের নারীরা। গ্রামে গঞ্জে সবার কাছে সব সময় টাকা থাকে না । বাড়িতে ধান থাকে ধান দিয়ে কেনা বেচাই বেশি হয়। তবে আগে সবাই ধান দিয়েই বেশি কিনতো এখন টাকা ও ধান যার যেটা থাকে সেটা দিয়েই কিনে। তিনি আরো জানান, প্রতিদিন বড়া বিক্রি শেষে আড়তে ধান দিয়ে টাকা নিয়ে যায়। অন্যদিকে আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি সপ্তাহে একদিন রাজশাহী থেকে দুই কার্টুন করে তিলের খাজা নিয়ে আসেন। বিক্রি শেষ হলে আবার গিয়ে নিয়ে আসেন।

Joider ali
জয়দার আলীর নিকট হতে প্রায় ডালে বড়া কেনেন ধাতমা গ্রামের রুবেদা বেগম। তিনি জানান, জয়দার আলীর ডালের বড়া খুব সুস্বাদ, আমরা বাড়িতে তরকারিতে তার ডালের বড়া খায়, বাড়িতে বাচ্চারা আছে তারাও এমনি এমনি ডালের বড়া পিয়াজু খায়। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে খুচরা টাকা থাকলে টাকা তার কাছে জিনিস কিনি না থাকলে ধান দিয়েই এগুলো কিনি। ধান দিয়ে কেনা যায় তাই কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাকে কখনও ঘুরতে হয় না।’

প্রবীণ বয়সেও আক্ষেপের স্বরে দুইজন বলেন, ‘অন্যকোন কাজ জানি না। দিন মজুরি করতে গেলেও আমাদের নিবে না। সংসার আছে কাম কাজ করার মানুষ নাই। যতদিন গায়ে শক্তি আছে ততদিন এই কাজই করে যাবো।’ প্রবীণ জয়দার আলী ও আমিনুল ইসলামের মত আমাদের সমাজে কত মানুষ আছে যারা তাদের জীবন সায়াহ্নে এসে প্রতিনিয়ত কাজ করে তাদের দিন যাপন করে যাচ্ছে। সমাজের বিত্তবান ও সরকারি ও বেসরকারি সুযোগ সুবিধা সহজতর হলে মিলবে এই সকল মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা।

happy wheels 2

Comments