ফুল হতে চাই

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

পৃথিবীর সেরা জীব মানুষ। মানুষ পৃথিবীতে জন্মের পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে যায়। আমরা মানুষ জাতি অনেক সময় সেই অবদানকে কখনো মনে রাখি আবার কখনো তা মনে রাখিনা। কিন্তু আমরা যার কাছ থেকে কিছু শিখছি বা গ্রহণ করছি নিশ্চই তার কথা মনে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। স্থান কাল পাত্র ভেদে আমরা সে নৈতিক দায়িত্বের দিকে কোন গুরুত্বারোপ করিনা। পিছনের কথা, কারো কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করা, কারো দেখানো পথ অতি সহজেই ভুলে যাই। আমরা বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার সময়ে অনেক কিছু বলি, অনেক উপদেশ, অনেক পরামর্শ প্রদান করি। কিন্তু বাস্তবে নিজের সাথে আমরা কেউ কোনদিন কি আর সেই উপদেশ বা পরামর্শ কে বিবেচনা করে চলি। আমরা প্রবীণ ও বার্ধক্য নিয়ে অনেকেই কথা বলি। সর্তিকার অর্থে কি আমরা বার্ধক্য সম্পর্কে জানি। বার্ধক্য সম্পর্কে একমাত্র প্রবীণ ব্যক্তিরা জানেন। আর কেউ জানে না। বৃদ্ধ বাবা-মা- দাদা-দাদি ও পরিজনদের কাছ থেকে যা জেনেছি বা যা শিখেছি তা কিন্তু আমাদের পুথি অর্জনকারী এই বইয়ের মধ্যে কোথাও নেই। আমাদের বর্তমান সমাজে প্রবীণ ও বিধবা ব্যক্তি এই দু’শ্রেণীর মানুষরা নানান সমস্যায় জর্জারিত। একজন প্রবীণ হলে হয়ে যায় সে শিশু। তাকে একটি শিশুর মতো করে ভালোবাসতে হয়। বয়সের সাথে সাথে নানান সমস্যা হাজির হয়। না পারে একা চলতে ফিরতে, খাওয়া দাওয়া করতে, সাথে শরীরে নানান ধরনের বার্ধক্যজনিত রোগ এসে বাসা বাঁধে। এসময় দরকার অন্যের সহায়তা সহানুভূতি ও ভালোবাসা।

IMG20190521101355

অপরদিকে বিধবা সেই নারীরা তাকে অপায়া বলা হয়। কোন কারণে স্বামী হারা হলে তাকে সমাজে নানান বঞ্চনার শিকার হতে হয়। কোন পরিবারের যদি ছোট বাচ্চা রেখে সে পরিবারের কর্তা বা যে পুরুষ ব্যক্তিটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। তখন সে নারীটা পারিপাশ্বিকতার বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে টিকে থাকতে হয়। যেমন ছেলে মেয়ে ও পরিজনদের দেখভালের জন্য, সংসারে অর্থ উপার্জনের কাজের উদ্দেশ্য বাইরে যেতে হয়। বাইরের বিভিন্ন পরিবেশের সাথে তাকে খাপ খাওযাতে হয়। অনেক সময় প্রবীণ ব্যক্তিটি ও বিধবা নারী তার সমস্যার কথা, কোন অসুখ, কোন কিছু খেতে ইচ্ছে হলে, পরিবারের পরিজনদের কিছু দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ হলে সংসারে ছেলে, মেয়ে, ছেলের বৌদের কাছে হাত পেতে কিছু চাওয়ায় অস্বস্থিবোধ করেন। অনেকে পরিবার থেকে সহায়তা পান আবার অনেকে পান না।

বিগত সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে বয়স্ক ও বিধবা ব্যক্তিদের সাথে একক বা দলীয় বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে উপরোক্ত সমস্যার কথা উঠে এসেছে। বারসিক দীর্ঘদিন ধরে ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষকে ও তাদের শক্তিকে জানা বোঝা এবং পারস্পারিক সম্পর্ককে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। সাথে বিভিন্ন ধরনে সমস্যা, সুযোগ ও সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বারসিক সমাজের সকল শ্রেণী, পেশা ও বিভিন্ন বয়সের মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরির মানসিকতায় কাজ করছে সেখানে আমাদের প্রবীণ এবং বিধবা ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত।

গত এপ্রিল ও মে মাসে শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের কাঠালবাড়ি গ্রামে ৫ জন প্রবীণ ও ৫ জন বিধবা ব্যক্তির সাথে দলীয় আলোচনা হয়। আলোচনায় বর্তমান সময়ে সমাজে তাদের অবস্থান এবং সরকারি যে ভাতা প্রদান করা হয় সে ভাতা পেতে এবং তা পেয়ে তাদের কি রকম উপকার হচ্ছে এবং না পাওয়ার কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে সে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অংশগ্রহণকারী প্রবীণ ব্যক্তি ফকির আলি গাজী (৭৫) বলেন, ‘বর্তমান সময়ে আমাদের যে অবস্থান তা আমরা প্রকাশ করতে চাই না। আমরা যেভাবে আাছি এভাবে থাকতে চাই। আমাদের সন্তানদের খারাপ আমরা চাই না। সন্তান ভালো খারাপ সে তো আমার। তাদের অবস্থা তো খুবই ভালো না। তারা নিজে ভালোভাবে চলতে পারেনা সেখানে বাপ মাদের আর কিভাবে রাখবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এ গ্রামে প্রায় ৪৫ জন প্রবীণ এবং ২৫ জনের মতো বিধবা নারী আছে। সরকারি যে ভাতা দেয় এ ভাতার কার্ড সকলেই পায় না। আর এ কাড পাওয়ার জন্য আমাদের এই বুড়ো বয়সে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। অনেক চেষ্টা করার পরও অনেক সময় সেই কার্ড পাই না। আবার অনেকসময় তারা যেটা চায় তা দেওয়ার সামর্থ্যও আমাদের থাকে না। অনেক কষ্টের পরও যদিও কার্ড হয় তাও ৫০০ টাকা দিতে হয়।’

IMG20190521102720
অন্যদিকে বিধবা নারী আকলিমা বলেন, ‘আমার স্বামী মারা যাওয়ার ৮ বছর পরে এসে আমি বিধবা ভাতার কার্ড পেয়েছি। কার্ড পাওয়ার জন্য মেম্বার, চৌকিদার, গ্রামের শিক্ষক, গ্রামের গণ্যমান্য মানুষের দ্বারে দ্বারে অনেকবার করে যেতে হয়েছে।’ প্রবীণ ব্যক্তি আক্কাস গাজী (৭১) বলেন, ‘এখন বয়স হয়ে গেছে। আমরা এখন আর ফুটবল হতে চাই না; ফুল হতে চাই। যাতে সকলে আমাদের গ্রহণ করে এবং ভালোবাসে। আমার ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ে। প্রত্যেক ছেলে একমাস করে খেতে দেয়। এখন এই বয়সে ৪ জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। যা লবণ পানি জোটে এক জায়গায় হলে ভালো হয়। আমার মতো এরকম অনেক পরিবার আছে যেখানে বুড়ো বয়সে বুড়ো বুড়িকে ছেলেরা ভাগ করে নেয়। বুড়ো বুড়িকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় মন না চাইলে ছেলেমেয়ে-নাতী-পুতিদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু মানিয়ে নিতে হয়।”

অন্য অংশগ্রহণকারী হালিমা, মফিজা, নুরজাহান, রাবিয়া, নাজমুননাহার, রেকেয়ারা জানান, সরকারিভাবে যে ভাতা পান সেটা পরিমাণে খুবই কম। যদি কোনভাবে সরকার এটাকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করতো তাহলে তাদের একটু উপকার হতো। কারণ সবসময় তারা ছেলেমেয়েদের কাছে হাত পাততে চান না। বর্তমান সময়ে জিনিস পত্রের দামও বেড়ে গেছে। নিজেদের অনেক কিছু খেতে মন চায়, নিজেদের চিকিৎসা খরচ চালাতে, কাপড়-চোপড় কিনতে এসময় অর্থের দরকার হয়। তাদের প্রত্যেকের দাবি যে, ভাতার টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে যাতে ১০০০ টাকা এবং তা যেন মাসে মাসে প্রদান করা হয় এবং সকল প্রবীণ ও বিধবা ব্যক্তিদের এ ভাতা কার্ড যেন নিশ্চিত করা হয়।

happy wheels 2

Comments