নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজন আয়বর্ধনমূলক কাজে নারীর অংশগ্রহণ
মানিকগেঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
‘নারী নির্যাতন বন্ধ করি, কমলা রঙের বিশ্ব গড়ি’-এ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ২০২১ উপলক্ষে গতকাল মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের দিয়ারা ভবানীপুর গ্রামে বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সকল ধরণের বৈষম্য প্রতিরোধে আলোচনা সভা ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বারসিক’র সহযোগিতায় দিয়ারা নারী উন্নয়ন সংগঠন দিবসকে কেন্দ্র করে এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
আলোচনায় নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘নারী নির্যাতন বন্ধ নিজেদেরই করতে হইবো। আমরা যদি ভালো কাজ করি স্বামীরা নির্যাতন করতে পারবো না। আমরা ঘরে-বাইরে দুইজন সব কাম মিলেমিশে করি। আমরা খুব ভালো আছি। আমরা সবাই মিলে বাল্যবিয়ে বন্ধ করবো।’শিল্পী বেগম বলেন, ‘আমরা নারীরা সংসারে অনেক কাম (কাজ) করি। তাও স্বামীরা কয় (বলে) কি কাম করো সারাদিন। এটা শুনে আমাগো (আমাদের) খারাপ লাগে। তাইলে তো এটাও নির্যাতন। আমরা তো নির্যাতন সহ্য করবোই। কারণ আমাগো কাজে তো কোনো টাকা আসে না। তাই আমাগো কামরে কামই মনে করে না। তাই আমাগো আয়মূলক কাম করতে হইবো। তাইলে আমাগো গুরুত্ব বাড়বো।’
বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল চন্দ্র রায় বলেন, ‘২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুর দিন। ঐ দিন রোকেয়া দিবস পালন করা হয়। নারীরা পরিবারে, রাস্তাঘাটে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এর জন্য আইন হয়েছে। কেউ চাইলেই কাউকে নির্যাতন করতে পারবে না। আপনাদের ছেলেমেয়ে, নাতি- নাতনীদের বাল্যবিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে যাতে তারা কাজ করে খেতে পারে। তবেই তো নির্যাতন কমবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আপনাদের বেশি বেশি যুক্ত হতে হবে। তবেই সংসারে আয় উন্নতি বাড়বে। নির্যাতন কমে আসবে।’
রাজেদা বেগম বলেন, ‘অনেক সংসারে বউরা শ্বাশুরীদের নির্যাতন করে আবার শ্বাশুরী বউগো নির্যাতন করে। কেউ কাউরে সহ্য করতে পারে না। সবাই সবাইকে ভালোবাসতে হবে। তাইলে সংসারে নির্যাতন কমবো।’ সনিয়া আক্তার বলেন, ‘আজকাল বাবা-মায়েরা বুঝে না তাদের ছেলেমেয়েদের বাল্যবিয়ে দেয়। ছোট বয়সে মেয়ে যখন সংসার করতে পারে না তখন তার উপর নির্যাতন শুরু হয়। অনেকসময় নির্যাতন করতে করতে মেরেও ফেলে শ^শুর বাড়ির লোকজন। তাই আমাদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। মেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে হবে।’
আলোচনা শেষে বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সকল ধরণের বৈষম্যের প্রতিবাদে মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধন শেষে নারীদের অংশগ্রহণে ভারসাম্য দৌঁড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় ৩০ নারী অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
এর আগে দিয়ারা নারী উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি নুরুন্নাহার বেগমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভার শুরুতেই দিবসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রবন্ধ পাঠ করেন শিক্ষার্থী সনিয়া আক্তার। প্রবন্ধে নারীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। ঘরে বাইরে কোনো জায়গায় নারীরা নিরাপদ নয়। জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্ট মতে, বারংলাদেশে ৬০ শতাংশ নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন। এছাড়াও বিশ^জুড়ে প্রতি ১০০ জনে ৭ জন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিখার হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার দেশ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করার জন্য প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল নামের তিন বোনকে হত্যা করা হলে তাদের স্মরণে ১৯৮১ সাল থেকে এই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে দিবসটি স্বীকৃতি পায়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ ১৯৯৭ সাল থেকে দিবসটি পালন করে আসছে। এই দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা।