শামিমা নাসরিনের জীবনের গল্প
সাতক্ষীরা থেকে মহিরঞ্জন মন্ডল
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পূর্ব গড়কুমারপুর গ্রামের শামিমা নাসরিন (৩০) একজন আত্মপ্রত্যয়ী নারী। স্বামী, শাশুড়ী ও এক সন্তানসহ ৪ সদস্যের ছোট্ট সংসার তাঁর। স্বামী মাসুম বিল্লাহ (৪০) পেশায় দিনমজুর। ছেলে রাহুল (১০) ৫ম শ্রেণীতে পড়ালেখা করে। নিজেরা নদীর চরে খাস জমিতে বসবাস করলেও বসত ঘরের সামনে যেটুকু জায়গা আছে সেটাকে চাষ উপযোগী করে মৌসুমভিত্তিক নানা জাতের কৃষি ফসল উৎপাদন করে সংসারের আংশিক চাহিদা পূরণ করেন শামিমা নাসরিন। কিন্তু বাকি অংশ নির্ভর করতে হয় পুরোপুরি বাজারের উপর। অভাবের মধ্য থেকে নিজেই খুঁজতে থাকে নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক মুক্তির পথ। যুক্ত হয় বারসিক’র সাথে।
২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডেভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পূর্ব গড়কুমারপুর গ্রামে “সূর্যমুখী” সিএসও দলে যুক্ত হয় শামিমা নাসরিন। যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক দলীয় আলোচনায় সভায় অংশগ্রহণ করেন। কিছুদিন পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে তার পারিবারিক ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে মুদি ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল ও একটি ছাগল সহযোগিতা করা হয়। পরিবেশ প্রকল্প থেকে একই সাথে একটি কদবেল ও সবেদার চারা, কিছু বর্ষাকালীন বীজ ও দু’টি হাঁস সহযোগিতা পান তিনি।
এরপর বারসিক এর নিয়মিত আলোচনা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় তিনি নিজেকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করার সুযোগ পান। সেলাই মেশিনের কাজ শেখার তার প্রবল ইচ্ছা, কিন্তু হাতের কাছে তেমন কোন প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ না থাকয় তিনি দর্জির কাজের প্রশিক্ষণ নিতে পারেন না। ফলে মুদি ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সহযোগিতা পাওয়ার পর সেগুলো বিক্রির মাধ্যমে নিজের আয়ের চাকা কিছুটা সচল হয়। গ্রামের মানুষ তার কাছে আসলেই নিত্য প্রয়োজনীয় মুদি মালামাল পেয়ে যায়। এভাবে দৈনিক মুদি ব্যবসার মাধ্যমে তাঁর আয় বেড়তে থাকে। কিন্তু এই আয় তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে তিনি সেলাই মেশিনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য খোঁজ নিতে থাকেন যে কোথা থেকে নেওয়া যায়।
একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন যে বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্পের অংশগ্রহণকারী সদস্যদের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তিনি তার আগ্রহের কথা সংস্থার প্রতিনিধিকে জানান এবং প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে যুক্ত হন। তিন মাস স্থানীয় পর্যায়ে সুন্দরভাবে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। প্রশিক্ষণ তো নিলেন কিন্তু কাজ করার জন্য সেলাই মেশিন তার নেই, নিজের টাকা দিয়ে কেনারও সামর্থ্য তার নেই। ফলে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও যে কাজটা শিখেছেন সেটাকে মনে রাখার জন্য অন্যের বাড়িতে যেখানে সেলাই মেশিন আছে সেখানে গিয়ে অনুশীলন করতে থাকেন। কিন্তু অন্যের মেশিন হওয়ায় বেশিক্ষণ বসে কাজ করতেও দেয় না। ফলে দর্জি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও সেটি খুব একটা লাভ হলো না তাঁর। একটা সেলাই মেশিন আশু প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাঁর। তিনি বারসিক’র কাছে একটি সেলাই মেশিনের জন্য বিনীতভাবে দাবি জানান এবং তার অভাব ও প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। বারসিক থেকে তাকে একটি নতুন সেলাই মেশিন উপকরণ হিসাবে সহায়তা করা হয়। এখন তিনি তার নিজের বাড়িতে সেলাই মেশিনের কাজ করতে থাকেন এবং গ্রামের মানুষের কাছ থেকে দর্জি কাজের অর্ডার নিয়ে কাজ করতে থাকেন। গ্রামের মানুষও তার কাছে ভালোই কাজের অর্ডার দিতে থাকে। নিজের কাছে মানুষ একদিকে সেলাই মেশিনের মাধ্যমে হাতের তৈরি পোশাক তৈরি করতে আসেন অপরদিকে গ্রামের মানুষ তার কাছে নিত্য প্রয়োজনীয় মুদি মালামাল কেনার জন্য আসেন। এভাবেই দুটি বিষয়ের বদৌলতে তার দৈনিক আয় বেড়ে যায়। তিনি তার আয়ের টাকা সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলেটাকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে চান।
শামিমা নাসরিন এ বিষয়ে বলেন, “স্বামীর একার আয়ে বর্তমান সময়ে টিকে থাকা কষ্টকর, তাই সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের কাজ করি বিশেষ করে সেলাই মেশিন ও মুদি ব্যাবসা করে আয় করছি। আমি বারসিক থেকে সেলাই মেশিন ও মুদি ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সহযোগিতা নিয়ে আমার ব্যবসাটাকে আরও ভালোভাবে চালু করতে পারছি। লাভের টাকা দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে নিয়মিত সঞ্চয় জমা করি।” সপ্তাহ বা ১৫ দিন পর পর মালমাল বিক্রির টাকা একত্রিত করে পুনরায় মালামাল কিনে এনে ব্যবসাকে সমৃদ্ধি করে চলেছেন।
শামিমা নাসরিনের মত এমনিভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা নিজেদের আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন জয়ের আশায় কঠোর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একজন নারী যোদ্ধা হিসেবে উপকূলীয় নারীদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।