হেমন্তের প্রকৃতি ও জীবন
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ
‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা রেখে/ অলস গেঁয়োর মতো এই খানে-কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার/ চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ/ তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে উঠে ধান’। হেমন্তের আসল রূপের বর্ণনা মেলে প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দের কবিতায়।
প্রকৃতি রঙ বদলায় তার নিজস্ব নিয়মেই। প্রকৃতির পরতে পরতে কত বিচিত্র রং যে মিশে আছে! চোখ খুলে দেখলে, মনের গহিনে তা উপলব্ধি করলে প্রাণ যায় জুড়িয়ে। বারংবার প্রকৃতি তাই বিশ্ব চরাচরে এক রহস্যের নাম। বিশেষ করে বাংলা ঋতুর বহু বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ মানুষ মুগ্ধ করে। বিস্মিত করে। এক অভাবনীয় রূপবিভায় বাংলার ঋতু-প্রকৃতি প্রতিটি বাঙালিকে ভাবালুতায় নিমজ্জিত করে। অনাদিকাল থেকে চলে আসছে এ প্রক্রিয়া।
হেমন্ত ঋতুতে প্রকৃতি ও মানুষের রূপবদল বড় অপূর্ব দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে কেবল হলুদ রঙের ধান আর ধান। দলে দলে মানুষজন সেসব ধান কাটে, আঁটি বাঁধে আর সেসব ধানের আঁটি বাগের দু’পাশে দাঁড়িপাল্লার মতো ঝুলিয়ে বাগ কাঁধে বাড়ি ফেরে। কোথাও বা সেসব ধানের আঁটি বোঝাই গরুর গাড়ি মেঠো পথের ক্যাচর ক্যাচর শব্দ তুলে গৃহস্থের বাড়ি বা ধানখোলার পথে চলে। ভোর থেকে হেমন্তের কুয়াশা নেমেছে মাঠে। বিন্দু বিন্দু শিশির জমে আছে ধান গাছের বুড়ো পাতায়। ক্ষেতের উপর ওড়াউড়ি করছে ফড়িংয়ের দল। সোনালি ধানের ক্ষেত ডিঙিয়ে প‚র্ব দিগন্ত রাঙিয়ে উঠছে ভোরের সূর্য হালকা শীত শীত ভোরের ভেতর মিষ্টি রোদের ওম, কি যে ভালো লাগে!
হেমন্তে শেষের দিকে গ্রামে আর একটি দৃশ্য চোখে পড়ে। গাছিরা কুয়াশা ভেঙে ধীর লয়ে হাঁটে, তর তর করে খেজুর গাছে ওঠে। ধারাল দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথা চেছে রস নামানোর আয়োজন করে। হেমন্তের মাঝখান থেকেই শুরু হয় সেসব রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর মহোৎসব। গাঁয়ের অনেক গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে বড় উনুন তৈরি করা হয়, তার উপর তাপাল রেখে খেজুরের রস জ্বাল দেয়া হয়। রস জ্বালের ঘ্রাণে সারা গাঁ মৌ মৌ করে।
হেমন্ত তো সেই মাছভাত খাওয়ারই ঋতু। দেশের অনেক বিল-ঝিল-হাওর-বাঁওড় এ সময় শুকাতে শুরু করে। আর সেসব শুকাতে থাকা জলাশয়ে ধরা পড়তে থাকে মাছ। হেমন্তের অনেক মানুষ সেসব মাছ ধরতে নেমে পড়ে বিলে-ডোবায়। নানা রকম দেশী মাছে বাজার তেঁতে উঠে। আইড়, বোয়াল, চিতল, বাঘাইড়, পুঁটি, ট্যাংরা-কত রকমের মাছ যে ধরা পড়ে। হাওর-বাঁওড়-বিলে তাই হেমন্তে রচিত হয় দলে দলে ধান কাটার পাশাপাশি মাছ ধরাও। মাছ ধরা শেষে ডুলাভর্তি মাছ নিয়ে বীরবেশে ঘরে ফেরে মানুষ। কিষাণির রান্নাঘর থেকে তাজা মাছ ভাজার ম ম গন্ধ চারদিকে জানান দেয়, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে…’। গ্রামের ঘরে ঘরে এই আনন্দ প্রবহমান থাকে-জাগরুক থাকে। এছাড়া হেমন্তে নানা ধরনের উৎসব-পার্বণে গ্রাম-বাংলার জীবন মুখরিত থাকে। থাকে আনন্দময়।
হেমন্তেই এখন অনেক শীতসবজিও উঠতে শুরু করেছে। আগাম বাঁধাকপি, ফুলকপি, পালংশাক, মুলা- কি নেই হেমন্তের বাজারে? একদিকে কৃষক ধান কেটে গোলায় তোলে, অন্যদিকে চৈতালি বা রবি ফসল বোনার কাজ শুরু করে। লাখ লাখ কৃষক-কৃষাণীর জীবনে যেন নেমে আসে এক অনাবিল পার্বণের আনন্দ, নতুন ধানে হয় নবান্নের উৎসব। এক কথায়, এক মহাব্যস্ততায় কাটে হেমন্ত কৃষকের দিনগুলো।
হেমন্ত আসে, হেমন্ত যায়। হেমন্ত মানেই আমরা এখন অনেকেই ভাবি নবান্নের ঋতু। কিন্তু হেমন্ত যে এক বহুরূপী প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ এক ঋতু, সে কথা ভুলে যাই। খানিকটা ঠাণ্ডা, খানিকটা গরম, অনেকটাই নাতিশীতোষ্ণ- এরকম এক আবহাওয়ার ঋতু হল হেমন্ত। কখনও ঝড়-মেঘ, কখনও কুয়াশা। সবুজ ধানক্ষেতগুলো ধীরে ধীরে সোনারঙে বদলে যাওয়া। অতিথি পাখিদের আগমন শুরু। গাঁয়ে গাঁয়ে খেজুর গুড় আর পিঠের ঘ্রাণ। ঝকমকে তাজা মাছে সাজানো জেলেদের ডালা। এই তো আমাদের অনেক রূপের হেমন্তের প্রকৃতি আর সে প্রকৃতির আশ্রয়ে আমরা একটু অন্যরকম হই হেমন্তের মানুষগুলো। কিন্তু ভয় হয়, যেভাবে পৃথিবীর জলবায়ু বদলাচ্ছে তাতে আগামীতে আমরা আমাদের এই আপন হেমন্তকে খুঁজে পাব তো!
শরতের শুভ্রতা শেষের হেমন্ত বাংলার জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। আশ্বিন-কার্তিক দুই মাস হেমন্তকাল। স্থায়িত্ব মাত্র দুই মাস কিন্তু এর প্রভাব অসীম। হেমন্তের স্নিগ্ধ, মায়াময় প্রকৃতির মধ্যে মানুষ যেন তার জীবনকেই খুঁজে ফেরে। খুঁজে পায়। এই ঋতুতে মানুষের আসে প্রেম, ইচ্ছা, আকাক্ষা, অভিলাষ এক ভিন্নমাত্রা পায়। হেমন্ত বাংলার মানুষের মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে ভাব, প্রকৃতিপ্রেম, বাঙালিয়ানা আর নিরন্তর সৃজনশীল কর্মকান্ড।
শিশির ভেজা দ‚র্বা ঘাস মাড়িয়ে প্রকৃতির মধ্যে হেমন্তের প্রবেশ সৃজনশীল মানুষের মন ও হৃদয়কে নানাভাবে চাঙ্গা করে-উজ্জীবিত করে। সহজিয়া মনের অলিন্দে অলিন্দে খেলা করে নিত্যনতুন সৃষ্টি। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রাপালা, বৈঠকী গান, পুতুলনাচ, জারি-সারি, বাউল গান, কবির লড়াই- সবকিছুতেই হেমন্ত এনে দেয় নতুন এক মাত্রা। দেশের অন্যতম প্রধান নারী কবি সুফিয়া কামাল ‘হেমন্ত’ কবিতায় লিখেছেন,
সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকেআনল ডেকে হেমন্তকে?
হেমন্তের অপার সৌন্দর্য মানুষের মনকে নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে এই সৌন্দর্য প্রেমিক হৃদয়কে মাতোয়ারা করে দিয়ে তার মনোলোকে তৈরি করে আশ্চর্য এক জগৎ যেখানে জীবন ও মানুষই হয়ে ওঠে ম‚লশক্তি। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’-এ অসাধারণভাবে হেমন্তের ছবি এঁকেছেন, তীব্র ভালবাসার উচ্চারণ করেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়’- তখন মন অজানা ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।