সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে কাজ করতে চাই
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
যখনই কোনো বড় কাজ বা মহৎ উদ্যেশ্য সফল হয়, এর পেছনে থাকে অনেকের অবদান। মানুষ একা কোনো বৃহৎ কাজ করতে পারেনা। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় সাধিত হয় সমাজ, গ্রাম ও দেশের উন্নয়ন। এরই প্রেক্ষিতে গত ২০ জানুয়ারি বারসিক রামেশ্বরপুর রিসোর্স সেন্টার এ লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের একজন করে প্রতিনিধি মিলিত হয়ে একটি কমিটি গঠন করে। যার মাধ্যমে ওই ইউনিয়নে বারসিক’র সহায়তায় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নে বর্তমানে গ্রাম সংখ্যা ২৮টি। তার মধ্যে ১৭টি গ্রাম বারসিক’র সাথে যুক্ত হয়েছে। এই গ্রামগুলোর মধ্যে বাস করে বিভিন্ন সম্প্রদায়। যেমন কর্মকার, রবিদাস, ছুতার, জেলে ইত্যাদি। আছে নানান পেশার জনগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন যাবৎ বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলে কাজের সুবাদে সে সমস্ত জনগোষ্ঠীর মানুষের ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বারসিক’র কাজের সাথে যুক্ততা তৈরি হয়েছে। তাঁরা নিজেদের অবস্থানে থেকে একদিকে যেমন বারসিক’র কাজকে সহায়তা করছে অন্যদিকে এলাকার কৃষি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করছে।
বিভিন্ন পেশা যেমন কৃষক, নাপিত, মুচি, চাকুরিজীবী, শিক্ষক, কামার প্রভৃতি পর্যায়ের জনগণ একত্রিত হয়ে আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের এলাকার সমস্যাসমূহ তুলে ধরেন। কর্মকার সম্প্রদায়ের যুবক শিক্ষার্থী সজীব চন্দ্র রায় বলেন, ‘কামারদের কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এই কাজে থাকছে না। তাছাড়া এই কাজের অন্যতম উপকরণ কয়লাও বর্তমানে পাওয়া যায় না। কারণ নারীরা আগে রান্না করার পর চুলার কয়লা তুলে তা জমিয়ে রাখতো এখন তা করে না। আমি কয়লা জমানোর আগ্রহ বাড়াতে নিজ গ্রামের অনেক নারীকে বিনামূল্যে চুলা থেকে কয়লা তোলার চামচ/হাতা তৈরি করে দিয়েছি। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।” তার পেশা কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সে বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়েছেন। এছাড়া রবিদাস সম্প্রদায়ের রঞ্জিত রবিদাস তাঁর নিজ গোষ্ঠীতে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতার অভাবে কি ধরণের সমস্যা হচ্ছে সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
সানকিউড়া গ্রামের যুব অংশগ্রহণকারী মোতালেব বলেন, ‘আধুনিকায়নের ফলে আমার গ্রামের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লোক সংগীত, কবিতা, গীত এগুলো বাদ দিয়ে যুবকদের অনেকেই শহুরে সংস্কৃতি আর হিন্দি ভাষার গান শুনতে অভ্যস্থ্য হয়ে পড়ছে।’ এবং এগুলো রক্ষা করতে তারা কি ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়েও আলোচনা করেছে। সে তার গ্রামে পাখি শিকার বন্ধে প্রচারণা ও নিষেধাজ্ঞাও জারি করে পাখি শিকার নিয়ন্ত্রণ করেছে।
নসিবপুর, ভাজনিপাড়া গ্রামের অংশগ্রহণকারীগণ কিশোরী ও নারীদের অবসর সময়ে অর্থনৈতিক কাজে যুক্ততা তৈরিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজনের প্রস্তাব করেন। তারা বলে যে অতীতে কুশি কাটার সেলাইয়ের প্রচলন ছিল এবং এটি খুব জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই কাজ চোখে পড়েনা। এটি কিভাবে শুরু করা যায় সে বিষয়েও অংশগ্রহণকারীদের কাছে পরামর্শ চেয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন গ্রাম প্রতিনিধিগণ নিজ গ্রামে কৃষিতে কি ধরণের সমস্যা আছে সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাছাড়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব পেশা ও সংস্কৃতি কি ধরণের সমস্যা মোকাবেলা করছে সে বিষয়ে আলোচনা করেন। সমাধানের পথ হিসেবে তাঁরা পেশাভিত্তিক জনসংগঠন গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ একত্রিত হয়ে কাজ করলে যেকোনো সমস্যা সমাধান করা যায় ও সফল হওয়া যায়।
অংশগ্রহণকারীগণ নারীদের বিনোদন, জ্ঞান ও দক্ষতা মূল্যায়নের বিষয়েও আলোচনা করেন। একজন নারী তাঁর পরিবারের সম্পদ। তিনি নিজের পরিবারের পাশাপাশি পরিবেশের উন্নয়নেও কাজ করেন। কৃষিতে তাঁর অবদানের কোনো মাপকাঠি নেই। তাঁরা অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার ও রক্ষায় নারীকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন।
আলোচনার এক পর্যায়ে বারসিক’র অন্যান্য কর্মএলাকায় চলমান কার্যক্রম ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলা হয়। নিজ নিজ গ্রাম ও সম্প্রদায়ের জন্য কি ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে সে বিষয়েও খসড়া পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পর এই কমিটি প্রতি দুই মাস অন্তর সমন্বয় সভা করবে বলে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।